ড. আবদুল আলীম তালুকদার
বাংলা নববর্ষ তথা পয়লা বৈশাখ আমাদের দ্বারপ্রান্তে। এ উৎসবের সময় বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ও যুদ্ধবিরতি চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। ইঙ্গ-মার্কিন আধিপত্যবাদীদের প্ররোচনায় জায়নবাদী দখলদার সন্ত্রাসী ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইলের সামরিক বাহিনী শত শত নবী-রাসূলদের স্বর্গভূমি ফিলিস্তিনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫১ হাজার নিরীহ-নিরপরাধ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এই সময়ে আহত হয়েছেন এক লাখ ১৫ হাজার ৩৩৮ জন। আর গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের হিসাবে, নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০। প্রতিদিন নিষ্ঠুর নেতানিয়াহু বাহিনী শত শত টন বোমা নিক্ষেপ ও নির্বিচার বিমান হামলা করছে গাজা উপত্যকা, খান ইউনিস, রাফাহসহ ফিলিস্তিনের ঘনবসতিপূর্ণ বিস্তর আবাসিক এলাকাগুলোতে যা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযানের একটি অংশ। এই অমানবিক হামলায় জুলুমবাজ ইসরাইলি বাহিনীর কবল থেকে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ কোনো কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হচ্ছে শিশু ও মহিলারা। পাশাপাশি গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হয়েছে, যা মানবিক বিপর্যয়ের দিকে পরিচালিত করেছে। স্পষ্টতই ইসরাইল বারবার আন্তর্জাতিক আবেদনের প্রতি কোনো গুরুত্ব দেয়নি এবং এর পরিবর্তে ক্রমবর্ধমানভাবে হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজা দখলের পরিকল্পনার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, সৌরপঞ্জি অনুসারে বাংলা মাস পালিত হতো অনেক প্রাচীনকাল থেকেই। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, উড়িষ্যা, মনিপুর, কেরালা, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরা, বঙ্গ, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই উদযাপনের রীতি ছিল।
আর সুপ্রাচীনকাল থেকে বাঙালিরাও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। নববর্ষ বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাই বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর হৃদয় নিংড়ানো উৎসব, মনের উৎসব, মননের উৎসব। এক কথায় পয়লা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতির সর্বজনীন উৎসব। এই উৎসব পালনে যেমন জাতি-ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ থাকে না তেমনি থাকে না ছোট-বড়, ধনী-গরিবের কোনো পার্থক্য। এটি সত্যিকারার্থেই একটি সর্বজনীন উৎসব, যা ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালিদের পাশাপাশি সারাবিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরা প্রতি বছর সাড়ম্বরে উদযাপন করে থাকে। পুরনো বছরের ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, ক্লেদ-গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে মহানন্দে বরণ করে নেয় তারা সমৃদ্ধি ও সুখময় জীবন প্রাপ্তির প্রত্যাশায়।
প্রাচীনকাল থেকেই বর্ষ গণনায় প্রধানত দু’টি পদ্ধতি চালু আছে। সূর্যের হিসেবে যে সাল গণনা করা হয় তাকে সৌর সাল বলে। সৌর সালের মাসগুলোর ঋতুর সাথে সম্পর্ক থাকে। হিজরি সন চান্দ্র সাল হওয়ায় এর মাসগুলো ঋতুর সাথে সম্পর্কিত নয়। তাই ভিন্ন ভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর সংস্পর্শে আসে হিজরি নববর্ষ। মানব সভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সময়, দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর প্রভৃতি হিসাব নির্ণয় করার মননও সঞ্চারিত হয় এবং সেই মনন থেকে সূর্য পরিক্রমের হিসাবেরও যেমন উদ্ভব ঘটে, তেমনি চন্দ্র পরিক্রমেরও উদ্ভব ঘটে। সূর্য পরিক্রমের হিসাবে যে বছর গণনার পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে তা সৌর সন নামে পরিচিত হয় আর চন্দ্রের পরিক্রমের হিসাবে উদ্ভাবিত সাল চান্দ্র সন নামে পরিচিত হয়।
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। আর হিজরি পঞ্জিকা চাঁদের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু কৃষকদের কৃষিকাজ চাঁদের হিসাবের সাথে মিলত না, তাই তাদের অসময়ে খাজনা আদায়ে কৃষকদের যেন কোনো অসুবিধা না হয় সে জন্য মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর সিংহাসনে আরোহণের ১৯ বছরে পদার্পণ করে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার তাগিদ অনুভব করেন। সম্র্রাটের আদেশ অনুযায়ী তার সভাসদ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি ১৫৫৪ সালের ১০ অথবা ১১ মার্চ চান্দ্রসন ও সৌর সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সনের প্রচলন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সালে)। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হিজরি সনের বর্ষকে বজায় রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিনে এনে একটি নতুন সন উদ্ভাবন করেন এবং সেই সাথে তিনি নক্ষত্রের নামের সাথে মিলিয়ে বাংলা ১২ মাসের নামকরণও করেন। এই সন ইলাহি সন, ফসলি সন প্রভৃতি নামে শাহী দরবারে পরিচিত হলেও বাদশাহ কর্তৃক গঠিত সুবা বাঙালা বা বাংলা প্রদেশে এসে এই সন বাংলা সন নামে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই মানুষ বাংলা নববর্ষে তাদের হিসাব-নিকাশ, দেনা পরিশোধ, খাজনা পরিশোধ ও বিভিন্ন প্রকার লেনদেন সম্পাদন করে আসছে।
প্রথমে বাদশাহ আকবরের পঞ্জিকার নাম ছিল ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ আর ওই পঞ্জিকায় মাসগুলো আর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর- এসব নামে। এক তথ্য হতে জানা যায়, হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমকে প্রথম মাস ঠিক রেখেই বাদশাহ আকবর কর্তৃক গঠিত বাংলা প্রদেশ বা সুবাহ বাংলায় এই নতুন সন প্রতর্তিত হয়। তখন এ অঞ্চলে মুহররমে ছিল বৈশাখ মাস। তাই এখানে নতুন সনের প্রথম মাস হিসেবে স্থির করা হয় বৈশাখকেই। এই বৈশাখ মাস হচ্ছে শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। এই বাংলা সনের সাথে শকাব্দের যে মাসগুলো সংযুক্ত করা হয় তার অধিকাংশেরই নামকরণ হয়েছে কোনো না কোনো নক্ষত্রের নামে যেমন- বিশাখা নক্ষত্রের নামে হয়েছে বৈশাখ মাস, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে আষাঢ় মাস, শ্রাবণা নক্ষত্রের নামে শ্রাবণ মাস, ভাদ্রপদা নক্ষত্রের নামে ভাদ্রমাস, অশ্বিনী নক্ষত্রের নামে আশ্বিন মাস, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে কার্তিক মাস, পুষ্যা নক্ষত্রের নামে পৌষ মাস, মঘা নক্ষত্রের নামে মাঘ মাস, ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামে ফাল্গুন মাস এবং চৈত্রা নক্ষত্রের নামে চৈত্র মাস। তবে বাংলা সনের অষ্টম মাস অগ্রহায়ণের নামকরণ কোনো নক্ষত্রের সাথে সম্পৃক্ত নয়। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে নববর্ষ সূচিত হতো হেমন্তকালের যে মাসটিতে সেই মাসটির নামকরণ করা হয়েছিল অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ অগ্র বৎসর।
ংলা নববর্ষ বহুমাত্রিকতায় পরিপূর্ণ। আগেকার দিনে নববর্ষের উৎসব-অনুষ্ঠান পল্লীকেন্দ্রিক এবং শুধু হালখাতা আর মেলার অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন তা পল্লীর সীমা ছাড়িয়ে শহরে ব্যাপ্ত হয়ে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ দিনে বাংলাদেশের ছোট-বড় শহর, উপশহর এমনকি গ্রামাঞ্চলে বসে বৈশাখী মেলা। মোসুমি ফলমূল, নানা রকম কুটির শিল্পজাতদ্রব্য, মাটি, কাঠ, বাঁশ, বেতের তৈরি প্রয়োজনীয় জিনিস ও খেলনাসামগ্রী যেমনÑ হাতি, ঘোড়া, গাড়ি, ঢাকঢোল, বাঁশি, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা ইত্যাদি কেনার ধুম পড়ে যায়। এসব মেলায় সাপখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, নাগরদোলার আয়োজন থাকে। জাতীয় ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নববর্ষের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বেশ কিছু দিন ধরে পান্তা ভাত ও ইলিশ ভাজা খাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে।
বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশীদের তথা বাঙালিদের নিজস্ব উৎসব। এ উৎসব আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে জাগ্রত করে, বর্তমানের মূল্যায়ন ঘটায়, জাতির আগামী দিনের রূপরেখাটির দিকনির্দেশনা দেয়। তাই বাংলা নববর্ষ আমাদের গৌরব, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। নববর্ষ উপলক্ষে সর্বজনীন উৎসবের মধ্য দিয়ে সারা দেশের এক অবিভাজ্য সাংস্কৃতিক রূপ ফুটে ওঠে।
আমাদের স্বর্ণালি অতীত ভুলে গেলে চলবে না। তাই সব অপসংস্কৃতিকে পায়ে দলে সোনালি অতীতকে ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী তরুণ প্রজন্মকে এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে। তবে পাশে এসে দাঁড়াতে হবে সবার কাছে উদাত্ত আহ্বানÑ আসুন পয়লা বৈশাখকে সামনে রেখে আমরা আমাদের মধ্যকার সব হিংসা-হানাহানি, বিভেদ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, পরশ্রীকাতরতা, পরস্পরের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ দূর করে সবাই মিলে বাঙালিত্বের মধ্যে একাকার হয়ে যাই; মুছে ফেলি মনের যত সব কালিমা। আমরা সবাই জাগ্রত হই অখণ্ড জাতীয় চেতনায়। আমরা ঋদ্ধ হই আগামীর গর্বিত প্রেরণায়। নতুন বছর আমাদের সবার জীবনে সুখ-সম্ভার-সম্প্রীতি বয়ে আনুক- এটিই হোক আজ নিরন্তর প্রত্যাশা।