ভালো মতো পুরো সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে তারপর জাতীয় নির্বাচন চায় দেশের ৫১ শতাংশ মানুষ। আর আগামী নির্বাচনে কাকে ভোট দেবে এমন প্রশ্নে নিরব ৪৮.৫ শতাংশ মানুষ। তবে পটপরিবর্তনের পর বিএনপির প্রতি যতটা আস্থা ছিল গত জুলাই থেকে সে আস্থায় বেশ খরা ধরেছে বলে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সার্ভের ফলাফলে বেরিয়ে এসেছে। সার্ভে বলছে, বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দলের (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা কমলেও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওস্থ জাতীয় আর্কাইভ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘বিআইজিডি পালস সার্ভে’-এর গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ভয়েস ফর রিফর্ম যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ফলাফল তুলে ধরেন বিআইজিডির ফেলো সৈয়দা সেলিনা আজিজ। এতে বক্তব্য রাখেন, বিআইজিডির পরিচালক অপরাশেন মেহনাজ রাব্বানী, ভয়েজ অব রিফর্মেও কো-কনভেইনার এ কে এম ফাহিম মাশরুর, বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান।
‘জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা জুলাই ২০২৫’ শীর্ষক এই জরিপ করেছে ভয়েস ফর রিফর্ম ও বিআইজিডি। অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরমেন্স, জনগণের সংস্কার প্রত্যাশা ও আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থনের ওপর সম্প্রতি এই জরিপ পরিচালিত হয়। সারাদেশের ৬৪ জেলায় পাঁচ হাজার ৪৮৯ জন নারী ও পুরুষের মধ্যে টেলিফোনে এই জরিপ পরিচালিত হয়। চলতি বছর জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে ২০ জুলাই এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে।
জরিপের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে যেখানে বিএনপিকে ভোট দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ, সেখানে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ১০ মাসে এসে তা কমে ১২ শতাংশে নেমেছে। বিপরীতে এনসিপির প্রতি সমর্থন ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর জামায়াতের অবস্থা ১১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে এখন ১০ দশমিক ৪ শতাংশে এসেছে। তবে ‘কোন দলকে ভোট দেবেন’ জরিপের এমন প্রশ্নে এখনো সিদ্ধান্ত না নেয়ার কথা জানিয়েছেন ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আপনি কাকে ভোট দেবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ২০২৪ সালের অক্টোবরে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছে, বিএনপিকে ভোট দেবে। সেখানে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে তা কমে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ভোট দেয়ার কথা বলেছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ, তা কমে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ১০ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। আর ২০২৪ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দেয়ার মত দিয়েছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, তবে চলতি বছরের জুলাইয়ে এসে তা ৭ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৪ সালে এনসিপির পক্ষে ভোট দেয়ার মত দিয়েছিল ২ শতাংশ। যা চলতি বছরের জুলাইয়ে সমর্থন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৮ শতাংশে। জাতীয় পার্টির প্রতি সমর্থন ২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে।
আর অন্যান্য ইসলামিক দলের সমর্থনও কমছে, ২ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। অন্যান্য দলের প্রতিও সমর্থন কমেছে জনগণের। যেখানে ২০২৪ সালে অন্যান্য দলে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়ার মত জানিয়েছিল, চলতি বছরের জুলাইয়ে তা কমে ১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে কোন দলকে ভোট দেবে এখনো সিদ্ধান্ত নেই এমন ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে। জরিপে ২০২৪ সালের অক্টোবরে যেখানে ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল, জুলাইয়ে তা বেড়ে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর ভোট না দেয়ার কথা জানিয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ। আর কাকে ভোট দেবে এমন তথ্য জানাতে চাননি এই জরিপে অংশ নেয়া ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ, যা গত অক্টোবরে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।
বিআইজিডি জরিপে অংশ নেয়া বেশিভাগ মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী। ৭০ শতাংশ বলেছেন যে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে জানিয়েছন ১৫ শতাংশ মানুষ। জরিপে অংশ নেয়া ৫১ শতাংশ মনে করে ভালো মতো সংস্কার করে তারপরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিছু জরুরি সংস্কার করে নির্বাচন চায় ১৭ শতাংশ। তবে জাতীয় নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হোক এমন বিষয়ে মত দিয়েছে ৩২ শতাংশ। আর ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে মত দিয়েছে ১২ শতাংশ। জুনের মধ্যে ১১ শতাংশ এবং ডিসেম্বর ২০২৬ অথবা এর পরে নির্বাচন হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে ২৫ শতাংশ।
জরিপে প্রশ্ন করা হয়, আপনার নির্বাচনী এলাকায় কোন দলের প্রার্থী জিতবে বলে আপনার মনে হয়। এমন প্রশ্নের উত্তরে ৩৮ শতাংশ জানিয়েছে বিএনপির প্রার্থী, জামায়াতে ইসলামীর ১৩ শতাংশ, আওয়ামী লীগের ৭ শতাংশ, এনসিপি ১ শতাংশ এবং অন্যান্য দলের ৩ শতাংশ প্রার্থী জিতবে বলে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন। এই প্রশ্নের উত্তরে জানি না বলে উত্তর দিয়েছেন ২৯ শতাংশ এবং প্রশ্নের উত্তর দেননি ৯ শতাংশ।
মূল প্রবন্ধের সার্বিক বিশ্লেষণ ও মূল বার্তায় বিআইজিডির ফেলো সৈয়দা সেলিনা আজিজ বলেন, বর্তমানে সমস্যার ধরন বহুমাত্রিক এবং এই সমস্যায় অর্থনীতির একতরফা প্রভাব কমেছে। এই বহুমাত্রিকতার কেন্দ্রে রয়েছে রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত সমস্যা এবং এগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অস্থিতিশীলতা। এই কারণগুলোর জন্যই অন্তবর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। মানুষ এই অস্থিতিশীলতার সমাধান খুঁজছেন দু’ভাবে, এক- নির্বাচন, দুই- সংস্কার। যদিও মানুষ নির্বাচনমুখী, তবু আমাদের ফলাফল অনুযায়ী একটি বিশাল গোষ্ঠী এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। ভোটের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়ন বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
আলোচনায় ড. মির্জা এম হাসান বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের মতের সাথে এলিট শ্রেণির মতের মিল নেই। এলিটরা বলছে, নির্বাচন হলে রাজনৈতিক সরকার এলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারা নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বার্থেও কথা বলেন।
তিনি বলেন, ৭০ শতাংশ যে বলছে নির্বাচন ভালো হবে তাতে অবাক হচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন সাধারণ মানুষ অর্থনীতি ও রাজনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এবার দেখা যাচ্ছে, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় হলে মানুষ আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগ দেয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে, বিশেষ করে মব নিয়ন্ত্রণে। শেখ হাসিনার আমলে তৈরি হওয়া ভয়ের সংস্কৃতি এখন আর নেই এবং তা ফেরানো সম্ভব নয়। নারীর অধিকার রক্ষায় সমর্থন বেড়েছে।’
ড. আসিফ শাহান বলেন, আগে ধারণা ছিল, অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে দেশ খারাপ হয়। কিন্তু এবার অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো থাকলেও মানুষ দেশকে ভালো মনে করছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। নারীরা ভোট ও রাজনৈতিক আলোচনায় পিছিয়ে আছে। কোনো দল তাদের সামনে তুলে ধরছে না।
তিনি বলেন, মানুষ সংস্কার চায় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। পুলিশ, অর্থনীতি ও শিক্ষা খাতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থা কমে গেছে, কারণ নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি পরে বাস্তবায়িত হয় না।