একুশ পেরিয়ে বাইশে নয়া দিগন্ত

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নয়া দিগন্তের ব্রত

এই একুশ বছর ধরে যারা আমাদের নিয়মিত পাঠক, যারা বিজ্ঞাপন দিয়ে, পত্রিকা বিপণন করে আমাদের চলার পথে সহযোগিতা করছেন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ শুভক্ষণে তাদেরসহ সব শুভানুধ্যায়ীকে জানাই হৃদয়নিংরানো ভালোবাসা। আগামী পথ চলায়ও আপনারা সাথে থাকবেন এই প্রত্যাশাই করছি।

নয়া দিগন্ত ২১তম বর্ষপূর্তি
নয়া দিগন্ত ২১তম বর্ষপূর্তি |নয়া দিগন্ত

সত্য প্রকাশ হলে কারো না কারো বিপক্ষে চলে যায়। তাই সত্য প্রকাশ করা সবসময় কঠিন একটি কাজ। বিশেষ করে কায়েমি স্বার্থের অনুকূলে থাকে না বিধায় সমাজ, রাষ্ট্র বা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সত্য প্রকাশের ঝুঁকি সবসময়ই কমবেশি ছিল। যদিও শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে সত্য প্রকাশে ঝুঁকি তুলনামূলক কম। তবে সেখানেও সত্য প্রকাশ আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে।

বর্তমান সময়ে গণমানুষের স্বার্থ রক্ষা হয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে। উন্নত বিশ্বে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকায় সেখানকার সংবাদমাধ্যম সরকারের গণস্বার্থবিরোধী অবস্থানের যৌক্তিক সমালোচনা করতে পারে। ক্ষমতাসীনদের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রকাশ করতে পারে কিছুটা বাধাহীনভাবে। এভাবে উন্নত দেশ নির্দিষ্টভাবে বললে পশ্চিমা বিশ্বে মিডিয়া জনস্বার্থ সংরক্ষণ করে থাকে। আমাদের দেশে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসানে গণমাধ্যমে আগের চেয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই বেড়েছে। তবু সত্য প্রকাশের আগে এখনো সংবাদমাধ্যমকে সাতপাঁচ ভাবতে হয়। এমন বাস্তবতায় ২১ বছর আগে সত্য প্রকাশের ব্রত নিয়ে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নয়া দিগন্ত। সেই থেকে আমাদের পথচলা শুরু। এ পথ কোনো সময় কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এরপরও থেমে নেই আমাদের পথচলা।

সময় কত দ্রুত বয়ে যায়। ফের অনুভবে ধরা দিলো নয়া দিগন্তের এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ বিশেষ মুহূর্তে। নয়া দিগন্ত যখন ২১ পেরিয়েছে, তখন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত পঙ্ক্তি নতুন করে স্মরণ না করে উপায় নেই। তিনি বলেছেন, ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ/... কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ’। কবি নজরুল যে উদ্বেগ নিয়ে এমন আহ্বান জানিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় জীবনে সেই পরিস্থিতির আজো সম্পূর্ণ অবসান হয়নি। যদিও দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়েছে। তবু জাতীয় জীবনের দিকে তাকালে যে কারো কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বাস্তবতা হলো- গণমাধ্যমই বারবার এ উদ্বেগ জানিয়ে সঙ্কট সমাধানে সত্যিকারের হাল ধরার বিষয়টি জনসমক্ষে হাজির করেছে।

আর যারা সত্যের জন্য কাজ করছেন তাদের ওপর প্রতিনিয়ত নেমে আসে বিপদ। এ অবস্থার মধ্যেও নয়া দিগন্ত ‘সত্যের সঙ্গে প্রতিদিন’ স্লোগান নিয়ে জনগণের কাছে প্রকৃত সত্যের বার্তা পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টায় নিরত। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান জটিলতা এবং বিচিত্র ও বহুমুখী ভাবনার প্রতিফলনে জনগণের কাছে নিরেট সত্য পৌঁছাতে বেগ পেতে হয় বরং দেখা যায়, প্রায় সব প্রচেষ্টা একপর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। অন্য দিকে ক্ষমতাবানরা তারস্বরে সেই পুরনো কথা প্রচার করে জনগণের মনোজগতে উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা চালান; ড. ম্যাকলের ভাষায় দাস বানিয়ে রাখতে চান।

২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে নয়া দিগন্ত আজ স্বভাবত স্মরণ করছে জন্মকালীন উদ্বেগের কথা। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসের প্রারম্ভে যেমন ছিল বাঁধভাঙা আনন্দ ও তীব্র শঙ্কা, তেমনি ছিল দৃঢ়প্রত্যয় সামনে এগিয়ে চলার। এ বিঘ্নসঙ্কুল পথের প্রতি বাঁকে ক্ষমতাবানরা দাঁড় করিয়েছেন দুর্লঙ্ঘ বাধার প্রাচীর আর বিপত্তি।

নয়া দিগন্ত প্রতিটি মুহূর্তে পাঠকের কথা ভাবে এবং সবসময় চেষ্টা করে ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে, মানে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে। এটি সবার জানা, সত্য প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে প্রয়োজন সাহস এবং যাদের জন্য এ সত্য, তাদের সহানুভূতি। এ ভূমিকা যে গণমাধ্যম পালন করতে চেয়েছে, তাকে বাধার প্রাচীর ডিঙাতে হয়েছে। নয়া দিগন্তের জন্যও এটি ছিল এবং আছে- বলা চলে একটু বেশি। পাঠকের পৃষ্ঠপোষকতা এ ক্ষেত্রে আমাদের জোগাচ্ছে অদম্য সাহস।

ভাবলে আজ মনে রীতিমতো শিহরণ জাগে, নয়া দিগন্ত জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা সামনে রেখে ২১ বছর ধরে পথ চলেছে। সময়ের এ পরিক্রমায় পাঠকের চাহিদা আমাদের বিবেচনায় প্রথম ছিল এবং এখনো তাই রয়েছে। এটিও সত্য, কায়েমি শক্তি পরিশেষে জনগণের ইচ্ছার কাছে নত হতে বাধ্য হয়। সেই সত্য সবার সামনে আবার ধরা দিয়েছে সাড়ে পনেরো বছরের শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে চব্বিশের ৫ আগস্টে ভেসে গেছে। নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। এ কাজে গণমাধ্যম অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

সব দেশে সব কালে এটিই চরম সত্য যে, তথ্য জানলে জনগণ শক্তিশালী হন। তাই ক্ষমতাবানরা তথ্যপ্রবাহ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট থাকে। বাংলাদেশেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এই পথ অবলম্বন করেন। একইসাথে তৈরি করেন একদল দলান্ধ সংবাদকর্মী। তারা প্রতিনিয়ত হাসিনার পক্ষে জনতার সম্মতি উৎপাদনে তৎপর ছিলেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে।

শেখ হাসিনার অপশাসনকালে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখেও শুধু পাঠকের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসায় নয়া দিগন্ত এগিয়ে চলেছে। টিম টিম করে বাংলাদেশে সত্য প্রকাশের গুরু দায়িত্ব পালন করেছে।

জনগণের তথ্য জানার অধিকার বাস্তবায়নের যে প্রচেষ্টা গণমাধ্যমগুলো করে যাচ্ছে, নয়া দিগন্ত সে প্রচেষ্টার সাথে আগামী দিনেও শামিল থাকবে ইনশাআল্লাহ। এখকার মুক্ত পরিবেশে জোর কদমে আগাবে সামনের দিনগুলোতে। সত্য প্রকাশে নয়া দিগন্তের রয়েছে দৃপ্ত অঙ্গীকার, যা জন্মলগ্ন থেকে এর সম্পাদকীয় নীতি। সে পথ থেকে নয়া দিগন্ত কখনো বিচ্যুত হয়নি এবং হবেও না। সত্য ও সাহসের সাথে বিগত দিনগুলো পার করে এ প্রত্যয়ে সামনে এগোচ্ছে নয়া দিগন্ত। বরং সত্যের সহযাত্রী হিসেবে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে চায়। সত্যিকার অর্থে একটা নতুন দিগন্তের সূচনা করতে চায়। মূলত নয়া দিগন্ত দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রিয় স্বদেশ ভূমি বাংলাদেশের মুখপত্র হিসেবে টিকে থাকতে চায়। তাই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নয়া দিগন্ত সম্পাদকীয় নীতি অক্ষুণ্ন রেখে নিজস্ব দর্শন আঁকড়ে ধরে পথ চলছে, যা এখন পরীক্ষিত সত্য।

প্রতিকূলতার মধ্যে নয়া দিগন্ত তার মূল লক্ষ্য, দর্শন ধরে রেখেছে। আর এখন ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে সেই প্রচেষ্ট আরো জোরদার করতে সচেষ্ট হবে। অর্থাৎ গণতন্ত্রের কথা আরো অর্থবহভাবে বলবে, মানুষের অধিকারের কথা বলবে। তাই প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করার যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তা ভবিষ্যৎ পথচলায় কাজে লাগাতে চায় নয়া দিগন্ত।

এই একুশ বছর ধরে যারা আমাদের নিয়মিত পাঠক, যারা বিজ্ঞাপন দিয়ে, পত্রিকা বিপণন করে আমাদের চলার পথে সহযোগিতা করছেন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ শুভক্ষণে তাদেরসহ সব শুভানুধ্যায়ীকে জানাই হৃদয়নিংরানো ভালোবাসা। আগামী পথ চলায়ও আপনারা সাথে থাকবেন এই প্রত্যাশাই করছি।