৩০ বছর পর ঢেলে সাজানো হয়েছে ওষুধ শিল্প সংক্রান্ত বেশ কিছু কমিটি। নতুন এসব কমিটি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জনবান্ধব, বাদ দেয়া হয়েছে স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীদের। আগে ফ্যাসিস্ট আমলের সুবিধাভোগীরা ওষুধ শিল্প সংক্রান্ত সব কমিটিতে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে স্বার্থ আদায় করে নিতো। ফলে উপেক্ষিত হয়েছে বৃহত্তর ভোক্তাদের অধিকার। তারা নিজেদের সুবিধামতো দামসহ নানা ধরনের স্বার্থ আদায় করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।
জানা গেছে, আওয়ামী আমলের ওই সুবিধাভোগীরা শুধু নিজেদের স্বার্থ আদায় করেই ক্ষান্ত ছিল না, তারা তাদের গ্রুপের বাইরের ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সব ধরনের হীনচেষ্টায় লিপ্ত থাকত। বর্তমানে এ ধরনের কোটারি স্বার্থবাদীদের বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটিগুলো সাজানো হয়েছে। ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন কমিটি করায় এখন ভোক্তাদের সুবিধা আগের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। কারণ নতুন কমিটিতে বিভিন্ন পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, নতুন কমিটিগুলোর মধ্যে ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রদানে টাস্কফোর্স’, ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর ১২ ধারা অনুসারে ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ এবং ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর ১২ ধারা অনুসারে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির টেকনিকেল সাব-কমিটি’সহ অনেক নতুন কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটিতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের সভাপতি ও সদস্যসচিব ও সদস্য করা হয়েছে।
ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি প্রণয়নের পর প্রথম ২০ বছর ওষুধ প্রশাসনে কোটারি স্বার্থবাদীদের প্রাধান্য ছিল না। সেখানে ভোক্তা স্বার্থ খুব বেশি উপেক্ষিত ছিল না। কিন্তু ২০০২ সালের পর কিছু কিছু কোটারি স্বার্থের পক্ষের লোকজন কমিটিতে ঢুকে গেলেও ২০০৯ সালের পর থেকে ভোক্তা স্বার্থ প্রকটভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। ওষুধ শিল্পের সাথে যুক্ত স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রীর কাছের একজন লোকই ওষুধ প্রশাসন, ওষুধের দাম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ এমনকি কোন কোম্পানিকে কী পরিমাণ নতুন ওষুধ দেয়া হবে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। পুরোপুরি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) ব্যাপার থাকলেও ওই গ্রুপটি দুর্দণ্ড প্রতাপে ওষুধ শিল্প এবং ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গেছে। ওষুধ কোম্পানির মালিকরা প্রথমে প্রতিনিধি হয়ে কমিটিগুলোতে ঢুকলেও পরে সমালোচনা হওয়ায় তারা প্রতিনিধির পদবি পরিবর্তন করে পর্যবেক্ষক নাম দিয়ে কমিটিতে থাকলেও ওই পর্যবেক্ষকরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন, কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করত না। বর্তমানে যে কমিটি হয়েছে সেটা স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে রাহুমুক্ত হয়েছে বলে ওষুধ কোম্পানির লোকেরাই বলছেন।
আগে শিল্প থেকে তিন থেকে পাঁচজন সদস্য থাকতেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন। এগুলো ছিল স্বার্থের দ্বন্দ্বের সবচেয়ে খারাপ ঘটনা।
‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রদানে টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ভিসি অধ্যাপক ডা: মো: শাহিনুল আলমকে। সদস্যসচিব করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (ওষুধ প্রশাসন অনুবিভাগ) মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন খানকে। এই কমিটির সদস্যরা হলেন বিএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ আরাফাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ঢাবির ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাকির আহমেদ চৌধুরী, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: শারমিন আব্বাসী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: শফিউল আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: শর্মিলা হুদাসহ ১৬ জন। এই কমিটিতে ওষুধ কোম্পানি কিংবা ওষুধ শিল্প সমিতির কোনো সদস্য নেই।
ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর ১২ ধারা অনুসারে ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি’র সভাপতি করা হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে। সদস্যসচিব করা হয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালককে। এটা ১৩ সদস্যের কমিটি। এখানে ওষুধ কোম্পানি কিংবা ওষুধ শিল্প সমিতির কোনো সদস্য নেই। এই কমিটিতে বিএমডিসি, বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, বিএমএ, বিএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের প্রতিনিধি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ও ক্লিনিকেল ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর ১২ ধারা অনুসারে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির টেকনিকেল সাব-কমিটি করা হয়েছে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালককে সভাপতি করে। এই কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসনকে। সদস্যরা হলেন বিএমইউর ভিসি, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক, আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজের কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান জেনারেল, আইইডিসিআরের পরিচালক, বিএমইউর মেডিসিন অনুষদের ডিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওষুধ প্রশাসন অনুবিভাগের যুগ্মসচিব, বিএমএর সভাপতি, বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি, বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিকেল সোসাইটির সভাপতিসহ ২২ সদস্যের কমিটি এটি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওষুধ সংক্রান্ত সব ধরনের কমিটিতে স্বৈরাচারের সহযোগীদের বাদ দিয়ে এরকম লোকদের নিয়ে কমিটি করলে ভোক্তাদের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে।