অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার
ডেঙ্গু হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক তালিকাভুক্ত একটি নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিস। অর্থাৎ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যারা বিশ্ব পরিক্রমায় অনুমিত বাসস্থানের সুবিধায় নিজেদের উপনীত করতে ব্যর্থ মূলত তাদের রোগ। মশা মাছির জন্য যে পরিবেশ অনুকূল, নিশ্চিতভাবে বলা যায় মানুষের জন্য সেই পরিবেশ অনুপোযুক্ত। যার অর্থ পরিবেশের দূষণ, পানির ব্যবস্থাপনা, পয়:প্রণালী নিষ্কাশন প্রভৃতি বাংলাদেশের নগরায়নের নিত্য সঙ্গী।
যতগুলো সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা রয়েছে সবগুলোর বর্জ্য ও পানির ব্যবস্থাপনা প্রধানতম সমস্যা। তাই তো সেই সুবিধাটুকু ভেক্টর বা মশা অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই গ্রহণ করে মনের আনন্দে রোগের জীবাণু বহন ও বিস্তার ঘটিয়ে মানুষের অতি মূল্যবান প্রাণের সংহার করেই চলছে।
এখন মশাবাহিত রোগ আর বর্ষা বেষ্টনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এবং ঢাকার গণ্ডিতেও আবদ্ধ নয়। পরিসংখ্যান হতে বোঝা যায়- ডেঙ্গুর ভয়াল থাবায় যে ইতিহাস বিখ্যাত তাণ্ডবলীলার ঘটনা ঘটেছিল ২০২৩ সালে। যেখানে বর্ষা পরবর্তী সেপ্টেম্বর মাস ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এই বছর এই মাসে সারাবছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের প্রায় এক তৃতীয় অংশ আক্রান্ত হয়েছিল এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর প্রায় এক চতুর্থাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল।
অক্টোবর মাসও ছিল খুবই ভয়ার্ত। নভেম্বরেও ডেঙ্গুতে একই রকম ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যায়। একইভাবে ২০২৪ সালেও ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত লক্ষ্য করা যায় অক্টোবরে এবং নভেম্বর মাসে। যার মধ্যে নভেম্বরের কার্ভটি ছিল একেবারে শীর্ষে। এখন আসি ২০২৫ সালে, এখন পর্যন্ত অর্থাৎ জুলাই আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্তের স্থান দখল করে রেখেছে। সেপ্টেম্বর ও একইভাবে কার্ভ শুরু হয়েছে।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে- আরো তিন মাস এই ভয়াল কার্ভ বেড়েই চলবে। এর লাগাম থামানোর যতগুলো প্যারামিটার রয়েছে তার এক তৃতীয়াংশও যদি সক্রিয়ভাবে কাজ করতো তাহলে আর এমন নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হতো না। মশক নিধন কার্যক্রমে ব্যবহৃত ব্যবস্থাপনার মধ্যে অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে কীটনাশকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। সার্বিক দিক বিবেচনায় কীটনাশক একটি আপদকালীন সময়ে কার্যকর পদ্ধতি। মশক দমনের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক মশার জীবনচক্রের লার্ভাল স্টেজে লার্ভি সাইড ও এডাল্ট স্টেজে এডাল্টিসাইড প্রয়োগ করা হয়। যদি সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিকভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় তবে অবশ্যই মশার ঘনত্ব কমবে। আর মশার ঘনত্ব কমলে নিশ্চিতভাবে কমবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যু হার।
এখন প্রশ্ন হলো- কীটনাশকের গুণগত মান, গুদামজাতকরণ প্রক্রিয়া, প্রস্তুতকরণ পদ্ধতি, মেয়াদ উত্তীর্ণ বিষাক্ত কীটনাশকের পরিবহন ডিসপোজাল পদ্ধতি সবকিছুই হতে হবে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে। একটি কার্যকর আইনের মাধ্যমে এসওপি বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রেসিডিউর অনুসরণ করে। এই দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে সর্বমহল হতে প্রতিধ্বনি উঠেছে প্রয়োগকৃত কীটনাশক কি আসলেই কীটনাশক নাকি অন্য কিছু। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ হয়তোবা নিজেরাও এই বিষয়টি আঁচ করে থাকবেন। এই বিষয়টি যদি যথাযথভাবে সমাধান করা না হয় তবে বছরের পর বছর অকার্যকর বা মেয়াদ উত্তীর্ণ অথবা কাঙ্খিত মাত্রার অ্যাক্টিভ ইনগ্রেডেন্ট ও ফর্মুলেন্ট বিহীন কীটনাশকের ব্যবহার শুধু মশার সেকেন্ডারি পেস্ট আউট ব্রেকই ঘটাবে না, ভয়াবহভাবে ভেঙে ফেলবে আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্যকে।
কারণ, যদি সঠিক ও কার্যকর মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ না হয় তবে টার্গেট পতঙ্গ না মরে মারা যাবে উপকারী কীটপতঙ্গ বা টার্গেট পতঙ্গের শত্রু। যা টার্গেট পতঙ্গের বা ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের দৌরাত্ম মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি করবে। এমন কথাও শোনা যায়, যেখানে এই কীটনাশক ক্রয়ের সময় যে নমুনা যাচাই বাছাই করা হয় এবং মাঠে যে কীটনাশক নিয়মিত প্রয়োগ করা হয় তার গঠন ও কার্যকারিতার মধ্যে বিস্তার পার্থক্য থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার কেনার পর কী প্রক্রিয়ায় তা গুদামজাত করা হয়েছে তার ওপরও এই কার্যকারিতার হেরফের হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই সকল প্রকার অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতে পারে ব্যবহৃত কীটনাশকের কার্যকারী উপাদানের কার্যকারিতার পরীক্ষা এবং ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তবে এই পরীক্ষা হতে হবে কোনো এক্রিডেটেড ল্যাব হতে।
একইসাথে একই নমুনা একটি বিশেষজ্ঞ টিমের উপস্থিতিতে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এক্রিডেটেড ল্যাবে পরীক্ষা সম্পূর্ণ করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত এই কার্যকারী উপাদানের সঠিকতার পরিমাপ না করা হবে, ততদিন মশার ঘনত্ব কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হবে না বলে অনেকের ধারণা। সম্ভব হবে না মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যুহার কমানো। বাংলাদেশের মতো এমন জনবহুল দেশে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব যেমনভাবে উপেক্ষিত, উপেক্ষিত নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ডামাডোলে মানুষের মৌলিক বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায় গুরুত্বের তালিকা থেকে।
মনে রাখা প্রয়োজন প্রতিটি জীবনই অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরোধযোগ্য কোনো রোগ যদি একটি জীবনও কেড়ে নেয় তা হবে অনাকাঙ্খিত। রাষ্ট্রের প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্তই এর অংশীজন। যারা মারা যাচ্ছেন তারা আমাদের সবারই আপনজন। নিজের স্বজন। কার্যকরী উপাদান পরীক্ষা আরো অন্য কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবহৃত ম্যালাথিয়ন ইতোমধ্যে তার বিষাক্ততার কারণে প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছে বলে বিভিন্ন দেশে প্রমাণিত।
আমরা জানি যে কোনো বিষাক্ত পদার্থ পেস্টিসাইড হিসেবে একদিক্রমে ৫ বছর ব্যবহৃত হলে তার কার্যকারিতা ও টার্গেট পোকা মাকড়ের প্রতিরোধী হয়ে ওঠার মাত্রা কীটনাশকের কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। আমাদের মনে থাকার কথা ১৯৩৯ সালে যখন পল হ্যারম্যান মুলার ডিডিটি আবিষ্কার করেন, তখন সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তাই তো ১৯৪৮ সালে তাকে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তার এই জগৎ বিখ্যাত আবিষ্কার মানবজাতির অভিশাপের পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। যার বিস্তর প্রমাণ মিলে রাসেল কার্সনের সাইলেন্ট স্প্রিং বইটিতে। তাইতো প্রচলিত বিষাক্ত পদার্থের কার্যকারী উপাদান পরীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল উপাদানগুলোর প্রয়োগের ওপর জোর দেয়ার সময় এসেছে। পরিবেশ ও মানবজাতির সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রচলিত কীটনাশকগুলোর বৈজ্ঞানিক এবং বাস্তবভিত্তিক এনালাইসিস করে তার প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিকল্প নেই।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) মহাখালী, ঢাকা।