ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, গবেষক ও প্রবাসে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার প্রাণপুরুষ আমীর আলী আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিটে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
১৯৩৬ সালের ২৬ মে ময়মনসিংহে জন্ম নেয়া আমীর আলীর পৈত্রিক নিবাস ছিল যশোর জেলার সারসার কাঠুরিয়া গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স, এমএ এবং পরে এলএলবি করেন তিনি।
তার শিক্ষাজীবন ছিল উজ্জ্বল, সুশৃঙ্খল, স্বপ্নময়। কিন্তু জীবনের পথ তাকে ডেকে নিয়েছিল অন্য এক মহৎ দায়িত্বে।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে কিশোর বয়সেই তিনি কারাবরণ করেন। তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মানবিক দায়বদ্ধতা তাকে কখনো থামতে দেয়নি। দেশের জন্য, ভাষার জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য তিনি যে মূল্য দিয়েছেন, তা ইতিহাসে শোক ও গৌরবের অক্ষয় রেখা হয়ে আছে।
পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে মেধার সাথে উত্তীর্ণ হলেও ভাষা আন্দোলনের জন্য চাকরি বাতিল হয়। কিন্তু এই অবিচার তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বরং প্রতিষ্ঠা করেছে সত্য ও নীতির অবিচল পথিক হিসেবে।
তার কর্মজীবন শুরু হয় ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার কলামিস্ট হিসেবে। পরে জগন্নাথ কলেজে ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষক, যিনি ভাষা ও চিন্তার মুক্তি শেখাতেন প্রজন্মকে।
১৯৬৪ সালে উচ্চশিক্ষার্থে তিনি লন্ডনে যান। সেখানেই তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়। সেটি ছিল আরো বিস্তৃত, আরো প্রেরণাদায়ক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের পক্ষে যুক্তরাজ্যে জনমত সংগঠনে তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রদূত। ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’ প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা আজ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ইস্ট পাকিস্তান হাউসের বাংলা মুখপত্র ‘পূর্ব বাংলা’ ও ইংরেজি মুখপত্র ‘এশিয়ান টাইড’ সবই তার হাতের ছাপ বহন করে।
১৯৭১ সালে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রবাস-ফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক। ‘বাংলাদেশ টুডে’ ও ‘সাপ্তাহিক জয়বাংলা’ এই দু’টি প্রকাশনার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
স্বাধীনতার পরে তার চিন্তা, গবেষণা ও লেখালেখিও থেমে থাকেনি। ফ্রন্ট বাংলাদেশ, সমাজ চেতনা, হলিডে প্রকাশনা থেকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে সৎ ও নির্ভরযোগ্য কণ্ঠ।
ব্রিটিশ সরকারের ‘কমিশন ফর রেশিয়াল ইক্যুয়ালিটি’র গবেষণা বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি অভিবাসী অধিকার, বৈষম্য ও সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে যে কাজ করেছেন, তা আজও উদাহরণ হয়ে আছে। তার গবেষণার ভিত্তিতেই ১৯৮৬ সালে ‘হাউস অব কমন্স’ প্রকাশ করে ঐতিহাসিক শ্বেতপত্র ‘Bangladeshis in Britain’। আর ১৯৯১ সালের আদমশুমারির ‘Ethnic Questionnaire’- এটিও তার অসামান্য মেধা ও অভিজ্ঞতার ফসল।
লেখক হিসেবে তার উজ্জ্বলতম অবদান ‘স্মৃতি অনিবার : একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস’ ও ‘আমার কাল আমার দেশ’ বইগুলো যেন তার বর্ণময় জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয়িত আলো।
‘সাপ্তাহিক জনমত’র মতো পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। নিরবে, বিনয়ের সাথে, কিন্তু দৃঢ় ও সত্যনিষ্ঠ ভাষায়। তিনি ছিলেন এমন একজন, যার উপস্থিতি কখনো উচ্চকণ্ঠ ছিল না। তবে যার প্রভাব ছিল সমুদ্রের মতো গভীর।
ভাষা সৈনিক আমীর আলীর মৃত্যুতে লন্ডনের বাংলাদেশী সমাজ তাকে স্মরণ করছে এক অপূরণীয় ক্ষতির বেদনায়। ক্যামডেন থেকে টাওয়ার হ্যামলেট যেখানেই বাংলাদেশীরা আছে, সেখানে আজ যেন এক নিরব শোক। কিন্তু তার রেখে যাওয়া আলোকরেখা, তার সাহস, সততা, দেশপ্রেম আমাদের কাছে রয়ে গেল ধ্রুবতারার মতো।



