বারবার ব্যর্থ হয়েও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক থেকে শিল্পপতি বাংলাদেশী হাফেজ

বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে স্বচ্ছলতার আশায় ২০০৮ সালে কলিং ভিসায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাফেজ হুসাইন আহমাদ পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। হার না মানা অদম্য হুসাইন দীর্ঘ ১ যুগ পর কারখানার শ্রমিক থেকে আজ প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি।

আশরাফুল মামুন, মালয়েশিয়া
বার বার ব্যর্থ হয়েও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক থেকে শিল্পপতি বাংলাদেশী হাফেজ
বার বার ব্যর্থ হয়েও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক থেকে শিল্পপতি বাংলাদেশী হাফেজ |নয়া দিগন্ত

বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে স্বচ্ছলতার আশায় ২০০৮ সালে কলিং ভিসায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানাধীন গোকর্ণ গ্রামের অনাথ যুবক হাফেজ হুসাইন আহমাদ পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। পবিত্র কোরআনের ৩০ পাড়া বুকে ধারণ করে এবং কওমি মাদরাসা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে প্রথম পেশা শুরু করেন মসজিদের ইমামতি।

কিন্তু অদম্য হাফেজ হুসাইন মালয়েশিয়ায় গিয়ে প্রথমে কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও কিছুদিন পর ব্যবসায় ইনভেস্ট করা শুরু করেন। তারপর কখনো হয়েছেন প্রতারণার শিকার, কখনো আবার প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়ে হারিয়েছেন সর্বস্ব। এতকিছুর পরও তিনি মনোবল হারাননি, বরং বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন দৃঢ়তার সাথে। হার না মানা অদম্য হুসাইন দীর্ঘ ১ যুগ পর আলোর দেখা পেয়ে কারখানার শ্রমিক থেকে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন শিল্পপতি হিসেবে।

তিলে তিলে মালয়েশিয়ায় গড়ে তুলেন ৫ হাজার বাংলাদেশী রেমিট্যান্স যোদ্ধার কর্মসংস্থানের দৃষ্টান্ত ‘উই ওয়ান অ্যাগ্রো গ্রুপ অব কোম্পানি’। তিনি মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করার পর এবার বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে শিল্প খামার স্থাপন করতে আগ্রহী। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন বহু মসজিদ মাদরাসাসহ সামাজিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় আড়াই কোটি টাকার একাধিক বাড়ি, স্থাপনা ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কওমি মাদরাসার সম্মানিত আলেম খোবাইব আহমাদ সিরাজীকে হাদিয়া হিসেবে দান করেছেন।

হাফেজ হুসাইনের প্রবাসী জীবন নানা পর্যায়ে উত্থান পতনের পর তার অর্জিত সাফল্যের কাহিনী প্রবাসে থাকা বাংলাদেশীদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ করে আত্মনির্ভরশীল হতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

মালয়েশিয়ায় গণহারে বাংলাদেশীরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন বিভিন্ন সেক্টরে, যাদেরকে বলা হয় পাকির্জা আসিং(সাধারণ শ্রমিক)। সেই অনুপাতে ব্যবসা, কৃষি ও শিল্পে তাদের সংখ্যা খুবই কম। প্রবাসী শ্রমিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা, কৃষি, খামার, শিল্প প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশীরা বিনিয়োগ করে এর লভ্যাংশে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যা আজ সর্বমহলে স্বীকৃত। কওমি মাদরাসা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এমন কিছু করার পরিকল্পনা করেন, যা শুধু দুনিয়াবী কাজে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে আখরাতের জন্যেও তার কৃত কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কোটি কোটি টাকার কমপ্লেক্স মসজিদ মাদরাসা সহ গোরস্থান নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।

মালয়েশিয়ান পার্টনারের সাথে সম্মিলিত ভাবে রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে কুয়ালা সেলাঙ্গরে প্রায় ৭০ একর বা ২৫০ বিঘা উর্বর ভূমিতে দিনে দিনে গড়ে তুলেছেন উই ওয়ান অ্যাগ্রো ফুড ভিলেজ। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দেশী বিদেশী গরু ও হাঁস মুরগির খামার। বাংলাদেশী সব ধরনের শাক সবজি খামার। বাংলাদেশী মাছের খামার। নির্মাণ সেক্টরে ঠিকাদারী কার্যক্রম সহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসা পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করেছেন। এ ধরনের যৌথ ব্যবসা ও বিনিয়োগে উভয় পক্ষ উপকৃত হচ্ছে যেমন নিজ দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীদের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশটির সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশটিতে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ১৫ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী প্রবাসী রয়েছেন বিভিন্ন খাতে কর্মরত। দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছেই। সম্প্রতির আলোচিত কলিং ভিসা চালু হলে এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। তাছাড়া এই সংখ্যার বেশিরভাগই মালোয় খাবারে অভ্যস্ত নয়। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশীদের দেশীয় খাবার মাছ, মাংস, শাক সবজির চাহিদা পূরণ করা হত বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আমদানি করে। আবহাওয়ার সাথে কিছুটা মিল থাকায় এখন মালয়েশিয়ায় স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশী খাবার উৎপাদন করে ১৫ লাখ প্রবাসীর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছে যা বাংলাদেশীর হাত ধরেই, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে এ খাতে সংশ্লিষ্ট সর্বমহল।

তারা দাবি করেন, যদি মালয়েশিয়ার জটিল শর্তযুক্ত ভিসা নীতি সহজ করা হয় তাহলে দেশটিতে আরো ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাবে, তেমনিভাবেই লাভবান হবে উভয় সরকার।