নেতৃত্বের জন্য জাইমার প্রস্তুতি!

সঙ্গী ‘দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি স্টোরিজ’

দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে নির্বাসন শেষে স্বদেশে ফিরতে জিয়া পরিবার বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ বিমান।

মাহবুব আলী খানশূর, লন্ডন (যুক্তরাজ্য)
জাইমার সঙ্গী যে বই
জাইমার সঙ্গী যে বই |সংগৃহীত

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একমাত্র মেয়ে জাইমা রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর পর লন্ডন থেকে মা-বাবার সাথে দেশে ফিরছিলেন বৃহস্পতিবার। সেসময় বিমানে তার সিটের পাশে একটি বই শোভা পাচ্ছিল। ধরেই নেয়া যেতে পারে জাইমা দীর্ঘ ভ্রমণে বইটিকে সঙ্গী করেছেন, পড়বেন বইটি। কিন্তু কী সেই বই? বইয়ের প্রচ্ছদ দেখা গেলেও বোঝা যাচ্ছিল না তার নাম। বইয়ের নাম ‘দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি স্টোরিজ’। রাজনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা নিজেকে ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য গড়ে তুলতে এ ধরনের বই পড়ছেন জাইমা।

দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে নির্বাসন শেষে স্বদেশে ফিরতে জিয়া পরিবার বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। ফ্লাইটে তারেক রহমান, স্ত্রী জোবায়দা রহমান ও কন্যা জায়মা রহমানের একটি ছবি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছে। ছবিটি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে।

বিএনপির ভবিষ্যত রাজনীতির একটি সিম্বলিক ছবি এটি। এই ছবিতে একটি ছোট জিনিস কিন্তু বিশেষ বিষয় নজর এড়িয়ে যায়নি। এ নিয়েও আলোচনা সরব।

ছবিতে দেখা যায়, তারেক-কন্যা জাইমার সিটের বিজনেস ডেস্কে একটি বই শোভা পাচ্ছে। বইয়ের নাম ‘দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি স্টোরিজ’। গত বছরের মার্চে ভারতের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন থেকে বইটি বেরিয়েছে। ৪৯৯ পৃষ্ঠার বইটির ইংরেজি অনুবাদক দিল্লির লেখক অরুণাভ সিনহা। এতে স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে শরৎ, মানিক, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, সত্যজিৎ, সুনীল, শংকর, সমরেশ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও শহীদুল জহিরসহ ৩৭ জন বাঙালি সাহিত্যিকের গল্প। ফিকশন এই স্টোরিগুলোতে আছে ননফিকশন বাস্তবতা। বইটিকে একটি সংকলন বলা যায়।

সংকলনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। এতে ভূমি যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, বর্ণপ্রথা, ধর্মীয় সংঘাত এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট স্থান পেয়েছে। এই সংকলনটি ইংরেজি ভাষায় প্রথমবারের মতো এক শতাব্দীর নির্বাচিত বাংলা ছোটগল্পকে একত্র করেছে। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, ব্যক্তিগত বেদনা, সামাজিক টানাপোড়েন ও মানবিক আনন্দ—সব মিলিয়ে জীবনকে শিল্পে রূপ দেয়ার এক বিস্তৃত চিত্র এতে ফুটে উঠেছে।

আমরা জানি, নানা চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে, জেল, নির্যাতন সয়ে একজন দক্ষ রাজনীতিক হতে হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে তারেক রহমান সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। কিশোর বয়সে বাবাকে নিহত হতে দেখেছেন। অল্প বয়সে মা বিধবা হয়েছেন। বাবা দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও কোনো সহায়-সম্পত্তি রেখে যাননি। নব্বই দশকে স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলেও নির্যাতন সয়েছেন তারেক।

বাংলাদেশে ২০০৭ সালে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষে রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে বিএনপির রাজনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয়। আবার খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের ছয় মাস আগেই গ্রেফতার হয়েছিলেন তারেক রহমানও। পরে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে চলে আসেন পরিবারসহ। ২০১৮ সালে কথিত দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে লন্ডন থেকেই দল পরিচালনার কাজ শুরু করেন তিনি।

শুধু তারেক রহমানই নয়, রাজনীতিতে প্রস্তুত হচ্ছেন জিয়া-খালেদার নাতনি তারেক-কন্যা জাইমা রহমানও। জাইমা নিজেও একজন ব্যারিস্টার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্টে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রেখেছিলেন যে জাইমা। এছাড়া এবছরের ২৩ নভেম্বর ব্যারিস্টার জাইমা রহমান প্রথমবারের মতো বিএনপির একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় অনলাইইনে অংশ নিয়েছেন। বিএনপি’র ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের সাথে প্রবাসী ভোটারদের ভোট কার্যক্রম বিষয়ে এক ভার্চুয়াল সভায় তিনি যুক্ত হন। এ সময় তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। রাজনৈতিক ময়দানে জাইমা রহমানের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি নতুন হলেও তার রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা শুরু বহু আগেই। ছোটবেলায় দাদী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তাকে প্রায়ই দেখা যেত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক আয়োজনগুলোতে।

তার আগে এবছরের অক্টোবরে বিবিসি বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারের সময় তারেক রহমানকে জিজ্ঞাস করা হয়েছিলো, বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব কতটা থাকবে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডা: জোবাইদা রহমান ও ব্যারিস্টার জাইমা রহমান যুক্ত হবেন কি না, এ বিষয়ে কিছুটা কৌশলী জবাব দিয়েছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘সময় পরিস্থিতি বলে দিবে ওটা।’

এদিকে, দলের একাধিক শীর্ষ নেতা মনে করছেন, ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করার পর জাইমার দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়া বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কাঠামোতে তার সক্রিয় ভূমিকার পূর্বাভাস হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, দেশ-বিদেশে দলীয় কর্মকাণ্ডে তার উপস্থিতি বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করবে।

উল্লেখ্য, লন্ডনের লিংকন্স ইন থেকে বার-অ্যাট-ল সম্পন্ন করেছেন জাইমা রহমান। এর আগে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ব্যারিস্টারি পাস করার পর থেকেই বিএনপি’র নেতাকর্মীদের মধ্যে তাকে ঘিরে নতুন প্রত্যাশার কথা শোনা যায়।

একদিকে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়া অন্যদিকে বাংলাদেশ ও রাজনীতি বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তুলছেন জাইমা। আর এবার নিজের অজান্তে আরো একটি ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন তিনি। বিমানে নিজের সঙ্গী করা একটি বই যেন অনেক কথা বলে দেয়। অনেক প্রস্তুতির জানান দেয়।