উৎসবের নগরীতে পরিণত ব্রিটেনের বাঙালিপাড়া

‘এ দেশের প্রায় ১২ হাজার রেস্টুরেন্ট ব্রিটেনে আমাদের সংস্কৃতি ও খাবার তুলে ধরেছে। আমাদের উচিত এদের টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের চেষ্টা করা। এ ছাড়া বাংলাদেশের জিআই পণ্য প্রচারে আমাদের নজর রাখা দরকার।’

মাহবুব আলী খানশূর, লন্ডন (যুক্তরাজ্য)
অনুষ্ঠানে ছিল কেক কাটা, ফটো প্রদর্শনী, বিভিন্ন কমিউনিটির সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ফেস পেইন্টিং, বেলুন মডেলিং, ফিটনেস সেশনসহ নানা পারিবারিক ও কমিউনিটি আয়োজন
অনুষ্ঠানে ছিল কেক কাটা, ফটো প্রদর্শনী, বিভিন্ন কমিউনিটির সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ফেস পেইন্টিং, বেলুন মডেলিং, ফিটনেস সেশনসহ নানা পারিবারিক ও কমিউনিটি আয়োজন |ছবি : নয়া দিগন্ত

তৃতীয় বাংলা হিসেবে পরিচিত ইংল্যান্ডের রাজধানীর পূর্ব লন্ডন। আর এই পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলেই বাস ব্রিটেনের সর্বাধিক বাংলা ভাষাভাষী মানুষের। গত শনি ও রোববার উৎসবের নগরীতে পরিণত হয় এই টাওয়ার হ্যামলেটস। একদিকে হোয়াইটচ্যাপেলে কাউন্সিলের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২৫০ বছরের পুরনো রয়েল লন্ডন হাসপাতালে নতুন টাউন হলের উদ্বোধন। অন্যদিকে বাংলা টাউন খ্যাত ব্রিকলেনে দীর্ঘ নয় বছর পর অনুষ্ঠিত হয় কারি ফেস্টিভ্যাল।

বিপুল সংখ্যক বাসিন্দা ও বিশিষ্ট অতিথিদের উপস্থিতিতে টাওয়ার হ্যামলেটস টাউন হলের ওপেন ডে অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের ৬০ বছর পূর্তি ও নতুন টাউন হলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় একই সময়ে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভীড় ছিল টাউন হলে।

আগতদের আলাদা আলাদা দলে পুরো টাউন হল ঘুরে দেখান স্থপতি এবং কাউন্সিলের অফিসাররা। পরে অতিথিদের, দর্শনার্থী এবং কাউন্সিলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে ফলক উন্মোচন করেন নির্বাহী মেয়র লুতফুর রহমান।

নতুন টাউন হল উদ্বোধনের পর মেয়র বলেন, আজ টাওয়ার হ্যামলেটসের জন্য এক গৌরবের দিল। এক ঐতিহাসিক দিন। আমাদের নতুন টাউন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলক উন্মোচনের সম্মান পেয়েছি আমি। এর মাধ্যমে ২৫০ বছরের প্রাচীন রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালকে পুনরুদ্ধার করে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি আবার জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। যে হাসপাতাল প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষকে সেবা দিয়েছে, আজ সেটিই রূপান্তরিত হয়েছে টাউন হলে– যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেবা দেবে। এটি সত্যিই এক মাইলফলক।

লুৎফর বহমান বলেন, আমি গর্বিত ও কৃতজ্ঞ যে আমি মেয়র হিসেবে এই ভবনটি অধিগ্রহণ করতে পেরেছিলাম এবং আজ আপনাদের সকলের সাথে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন টাউন হল উদ্বোধন করতে পারছি।

উল্লেখ্য, ১৭৫৭ সালে নির্মিত গ্রেড ২ তালিকাভুক্ত রয়েল লন্ডন হাসপাতালের পুরনো ভবনটি ২০১৪ সাল থেকে বন্ধ ছিল। ভবনটি প্রায় সাড়ে ৮ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ক্রয় করে কাউন্সিল। প্রায় ১৩০ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে সংস্কার শেষে ২০২৩ সালে কাউন্সিলের নিজস্ব টাউন হলে রূপান্তর করা হয়। নতুন নিজস্ব টাউন হল করার কারণে প্রতিবছর কাউন্সিলের সঞ্চয় হবে প্রায় ১৬ মিলিয়ন পাউন্ড। টাউন হলে রূপান্তরের পরে ২০২৫ সালে অসাধারণ নকশা এবং নির্মানশৈলীর ওপর ২০২৫ সালে দ্যা রয়েল ইন্সটিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিট্যাক্টস সংক্ষেপে রিবা লন্ডনের দুটি সম্মানজনক অ্যাওয়ার্ড ‘রিবা লন্ডন বিল্ডিং অব দ্যা ইয়ার’ এবং ‘রিবা লন্ডন অ্যাওয়ার্ড’ জিতে টাওয়ার হ্যামলেটসের নতুন টাউন হল।

নামফলক উন্মোচনে নির্বাহী মেয়রের সাথে ছিলেন ডেপুটি মেয়র কাউন্সিলর মায়ুম মিয়া তালুকদার, করপোরেট ডাইরেক্টর স্টিভ রেডি, ফ্যাসিলিটি হেড সারা স্টিয়ার্স এবং ব্যারোনেস পলাউদ্দিনসহ আরো অনেকে।

একই সময়ে দুই ডেপুটি ইয়ং মেয়র খাদিজা দিরির এবং ইফতি ভুইয়া বাংলায় লেখা একটি নাম ফলক উন্মোচন করেন।

নামফলক উন্মোচনের আগে লাভ টাওয়ার হ্যামলেটসের মঞ্চ থেকে অতিথিদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন নির্বাহী মেয়র লুতফুর রহমান। এর আগে চেম্বার হলে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ৬০তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিশাল একটি কেক কাটেন নির্বাহী মেয়র লুতফৃর রহমান এবং কাউন্সিলের চিফ এক্সিকিউটিভ স্টিফেন হৌলসিসহ অতিথিরা।

অনুষ্ঠানে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের চিফ এক্সিকিউটিভ স্টিভ হৌলসি বলেন, ‘নতুন টাউন হল শুধু একটি ভবন নয়, এটি আমাদের কমিউনিটির জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে, যা আমাদের সবার জন্য গর্বের বিষয়।’ এ সময় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, কমিউনিটি ও ধর্মীয় সংগঠনের নেতারা বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে ছিল কেক কাটা, ফটো প্রদর্শনী, বিভিন্ন কমিউনিটির সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ফেস পেইন্টিং, বেলুন মডেলিং, ফিটনেস সেশনসহ নানা পারিবারিক ও কমিউনিটি আয়োজন। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সংগঠনের স্টল নিয়ে ছিল কমিউনিটি মার্কেটপ্লেস।

Britain's-Bengali-neighborhood-turns-into-a-festival-city-1

নতুন টাউন হলের উদ্বোধন ও ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে টাওয়ার হ্যামলেটসবাসীর মধ্যে ছিল উৎসবের আমেজ ও গর্বের অনুভূতি।

টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল এবং বাংলা টাউন বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিবিএ) যৌথ উদ্যোগে ব্রিটেনের কারি ক্যাপিটাল খ্যাত ব্রিকলেনে দীর্ঘ নয় বছর পর অনুষ্ঠিত হলো বহু প্রতীক্ষিত ‘ব্রিকলেন কারি ফেস্টিভ্যাল’।

নয় বছর পর আবারো প্রাণ ফিরে পেলো এই বহুল জনপ্রিয় উৎসব, যা আবার ব্রিকলেনের সড়কগুলোকে মাতিয়ে তোলে। আগের চেয়ে সুস্বাদু খাবার আর বর্ণাঢ্য নানা আয়োজনে আবারো মেতে ওঠে হাজারো মানুষ। ২০১৬ সালের পর প্রথমবারের মতো ১৯ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর এই উৎসব ব্রিকলেনের ঐতিহ্যবাহী কারি রেস্তোরাঁগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। এখানে সবার সামনে প্রদর্শিত হয় বাংলাদেশী কমিউনিটির সমৃদ্ধ রন্ধনশিল্প, আর একইসাথে পরিবেশিত হয় স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় খাবার, সুর, সঙ্গীত আর সংস্কৃতির আনন্দঘন মুহূর্ত। দর্শনার্থীরা উপভোগ করেন মুখরোচক স্ট্রিট ফুড, শেফদের রান্না করার লাইভ প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং পরিবারকেন্দ্রিক নানা আকর্ষণ।

এই উৎসব আয়োজনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্রিকলেনকে আবারো যুক্তরাজ্যের শীর্ষ কারি গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং ফিরিয়ে আনা তার প্রাপ্য খেতাব- ‘কারি ক্যাপিটাল অব দ্য ইউকে’।

ব্রিকলেন কারি ফেস্টিভ্যালের তিন দিনব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর আয়োজন করা হয় বিনামূল্যের নানা কমিউনিটি ইভেন্ট, যেমন হেনা পেইন্টিং ওয়ার্কশপ, বাংলা স্টাইলের নাচ শেখা এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সাথে ‘ড্রেস-ফর-দ্য-ফেস্ট’ শপিং অভিজ্ঞতা।

‘ব্রিক লেন কারি ফেস্টিভ্যাল’র মূল উৎসব হয় ২১ সেপ্টেম্বর রোববার। এ দিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ব্রিক লেন মাতোয়ারা হয় মশলার ঘ্রাণে আর মানুষের কোলাহলে। বাংলাদেশ হাই কমিশনার আবিদা ইসলাম কারি ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে আয়োজিত র‌্যালিতে অংশ নেন। র‌্যালি শুরুর আগে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে আবিদা ইসলাম বলেন, বাংলাদেশীদের গোড়াপত্তন এই ব্রিকলেনে। এ দেশের প্রায় ১২ হাজার রেস্টুরেন্ট ব্রিটেনে আমাদের সংস্কৃতি ও খাবার তুলে ধরেছে। আমাদের উচিত এদের টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের চেষ্টা করা। এ ছাড়া বাংলাদেশের জিআই পণ্য প্রচারে আমাদের নজর রাখা দরকার।

রোববার সারাদিন চলে বিভিন্ন রেস্তোরাঁর সামনে আঞ্চলিক ও বিশেষ খাবারের স্টল, রান্নার প্রদর্শনী, উৎসব থিমযুক্ত স্ট্রিট আর্ট ও লাইভ গ্রাফিতি। বক্সটন স্ট্রিট থেকে ব্রিক লেন আর্চ পর্যন্ত হবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, থাকবে সজ্জিত ফ্লোট, নৃত্যশিল্পী, ডিজে, স্টিল্ট-ওয়াকার (লাঠিতে ভর করে হেঁটেচলা) ও জাদু প্রদর্শনীসহ নানা ধরনের বিনোদন। উৎসব উপলক্ষে অংশগ্রহণকারী রেস্টুরেন্টগুলো দিচ্ছে ২০ শতাংশ মূল্য ছাড়ের বিশেষ অফার।

এ প্রসঙ্গে টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান বলেন, ব্রিক লেন বিশ্বজুড়ে পরিচিত তার প্রাণবন্ত সংস্কৃতি আর অতুলনীয় কারির জন্য। তাই প্রায় এক দশক পর এই উৎসব ফিরিয়ে আনা আমার জন্য গর্বের বিষয়। এই উৎসব আমাদের ইতিহাস, স্বাদ এবং কমিউনিটির অসাধারণ বৈচিত্র্য উদযাপন করছে। ‘লাভ টাওয়ার হ্যামলেটস’ প্রচারণার মাধ্যমে আমরা স্থানীয় ব্যবসাকে সহযোগিতা করছি এবং ইস্ট এন্ডের চেতনাকে উজ্জীবিত করছি, আর তার সেরা উদাহরণ হলো ব্রিক লেন কারি ফেস্টিভ্যাল। পরিবার-পরিজন নিয়ে এসে ব্রিক লেনের সেরা সবকিছু উপভোগ করতে আমি সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।