ফ্রান্সে কর্মরত অনিয়মিত অভিবাসীদের বৈধতার নতুন নিয়ম চালু

তালিকাটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশের কথা ছিল। একাধিকবার পেছানোর পর অবশেষে এটি চূড়ান্ত করা হলো।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন, প্যারিস (ফ্রান্স)
অনিয়মিত অভিবাসীদের বৈধতার নতুন নিয়ম চালু
অনিয়মিত অভিবাসীদের বৈধতার নতুন নিয়ম চালু |নয়া দিগন্ত

২০২৪ সালের ফরাসি অভিবাসন আইনে ‘মেতিয়ের অঁ তনসিওঁ’ বা শ্রমিক সঙ্কটে থাকা খাতগুলোতে কর্মরত অনিয়মিত অভিবাসীদের বৈধতার নিয়ম চালু করা হয়েছে।

ফ্রান্সের শ্রম, স্বাস্থ্য, সংহতি ও পরিবার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সুপারিশকৃত তালিকাটি বৃহস্পতিবার (২২ মে) রাষ্ট্রীয় জার্নালে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশিত হয়।

ইনফোমাইগ্রেন্টস এর সূত্রমতে জানা গেছে, তালিকাটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশের কথা ছিল। একাধিকবার পেছানোর পর অবশেষে এটি চূড়ান্ত করা হলো।

এই হালনাগাদ তালিকাটি ২১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন খাতের সামাজিক অংশীদারদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। নতুন অভিবাসন আইনের আলোকে প্রতি বছর এটি হালনাগাদ করার কথা রয়েছে। সর্বশেষ তালিকাটি ছিল ২০২১ সালের, যা সময়োপযোগী ছিল না বলে অনেক অংশীদার সংস্থার দাবি ছিল।

নতুন তালিকায় হোটেল-রেস্তোরাঁ, কৃষি, গৃহকর্মী এবং ক্যাটারিংসহ বিভিন্ন নতুন পেশা যুক্ত করা হয়েছে। ফ্রান্সের ১৩টি রিজিওনের জন্য আলাদা আলাদা পেশাসহ কিছু কিছু পেশাকে জাতীয়ভাবে যুক্ত করা হয়েছে।

হোটেল-রেস্তোরাঁ সেক্টর যুক্ত করায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসা অনিয়মিত অভিবাসীরা সুযোগ পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এই সেক্টরে এসব দেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক অনিয়মিত অভিবাসী চাকরিতে যুক্ত আছেন।

নতুন তালিকায় সর্বোচ্চ ৪১টি পেশা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্যারিস ও আশপাশের অঞ্চলকে ঘিরে গঠিত ইল-দ্য-ফ্রঁন্স রিজিওনে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসকে ঘিরে গঠিত এই অঞ্চল দীর্ঘ দিন ধরেই অভিবাসী শ্রমিক নির্ভর। নতুন তালিকায়ও সেটির প্রতিফলন দেখা গেছে। 

তালিকায় শুধু গৃহকর্মী বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীই নয়, বরং প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, নির্মাণ এবং পরিবহণ খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব পেশা রয়েছে। এরমধ্যে আরো রয়েছে আইটি প্রকৌশলী ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক, শেফ বা বাবুর্চি, নার্স, রেস্তোরাঁ কর্মী, বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক কারিগরি দক্ষতা, নির্মাণকাজে জড়িত সুপারভাইজার, লজিস্টিক ম্যানেজার, ওয়েল্ডার, কাঠমিস্ত্রি, ছাদ বসানোর কারিগর, গাড়ি ও যন্ত্রপাতি মেরামতকারী এবং কৃষিশ্রমিক ও উদ্যানবিদ।

তবে নতুন তালিকা নিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁ সেক্টরের সংগঠন জিএইচআর হতাশা জানিয়েছে। তারা বলছে, ‘প্যারিস অঞ্চলে কেবল কুককে তালিকাভুক্ত করা হলেও রান্নার সহকারী বা ওয়েটারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশাগুলো বাদ পড়েছে। এটি আশ্চর্যজনক।’

ফ্রান্সের যে তিনটি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি কর্মী ঘাটতি রয়েছে সেগুলো হলো :

১. ইল-দ্য-ফ্রঁন্স বা বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চল (৪১টি পেশা)

২. প্রোভন্স-আল্পস-কোত দাজুর (৩৯টি পেশা)

৩. উবেরন-রোন-আল্পস (৩৭টি পেশা)

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানা ২০২৪ সালের অভিবাসন আইনে ‘মেতিয়ের অঁ তনসিওঁ’ বা গুরুতর শ্রমিক সঙ্কটে থাকা খাতগুলোতে কর্মরত অনিয়মিত অভিবাসীদের নিয়মিতকরণের স্বয়ংক্রিয় অধিকারের প্রস্তাব দিয়ে আইনে পরিণত করেছিলেন।

তবে অনুমোদিত আইনে ‘স্বয়ংক্রিয়’ বৈধতার পরিবর্তে কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে এক বছরের রেসিডেন্স পারমিট দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে প্রেফেকচুরগুলোকে।

এই পদ্ধতিতে বৈধতা পেতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে :

১. প্রার্থীকে ফ্রান্সে অন্তত তিন বছর বসবাস করতে হবে।

২. সর্বশেষ দু’ বছরে কমপক্ষে ১২ মাস তালিকাভুক্ত পেশায় কাজ করার প্রমাণ (যেমন পে স্লিপ) থাকতে হবে।

৩. কোনো ধরনের অপরাধে জড়িত না থাকা এবং পুলিশের ক্লিয়ারেন্স থাকা বাধ্যতামূলক।

৪. সমাজে একীভূত হওয়া ও ফরাসি মূল্যবোধের সাথে সংহতি দেখাতে হবে।

এই আইনের বড় সুবিধা হচ্ছে এখন থেকে অভিবাসীরা নিয়োগকর্তার সুপারিশ ছাড়াই নিজেরাই বৈধতার জন্য ফরাসি প্রেফেকচুরগুলোতে আবেদন করতে পারবেন। এই নিয়ম প্রাথমিকভাবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে এবং এতে স্টুডেন্ট জব ও সিজনাল কাজও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

চাকরি খোঁজা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সরকারি সংস্থা ফ্রঁন্স ত্রাবাইয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে শুধু হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতেই দীর্ঘ মেয়াদি ও স্বল্প মেয়াদি চুক্তির তিন লাখ ৩৬ হাজার পদ শূন্য থাকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি শূন্য পদে লোক খুঁজে পেতে নিয়োগকর্তারা গুরুতর বাধার মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।

ফরাসি ট্রেড ইউনিয়ন সিজিটি (সিজিটি)-এর সচিব জেরার রে বলেন, ‘এই তালিকাটি শ্রমমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যকার টানাপড়েনের ফল। এতে পুরোপুরি শ্রমবাজার ও প্রশিক্ষণের চাহিদার প্রতিফলন নেই।’

অন্যদিকে, অভিবাসন বিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়ো আবারও বলেছেন, ‘চাকরি দিতে হলে সবার আগে ফ্রান্সে থাকার বৈধতা আছে কিন্তু বেকার, এমন বিদেশী নাগরিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।’

অভিবাসনবিরোধী হিসেবে পরিচিতি আছে ফ্রান্সের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়ো।

তবে শ্রমমন্ত্রী আস্ত্রিদ পানোসিঅঁ-বুভে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই তালিকাটি দেশের শ্রমবাজারের চাহিদা, মানবিক বাস্তবতা ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারকে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘তালিকাটি প্রকাশ ও তার ব্যবহার একসাথে আমাদের সেই লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে, যেখানে বেকার বিদেশীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত, নির্বাচিত এবং জাতীয় স্বার্থে উপযোগী শ্রম অভিবাসন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।’

এই নতুন শ্রম আইনের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলে অনিয়মিতদের নিয়ে কাজ করে সিএসপি ৭৫ নামক একটি প্লাটফর্ম। কমোকো সো বলেন, ‘অনেক পেশা আছে যেগুলো অনিয়মিত অভিবাসীরা করে কিন্তু সেগুলো এই তালিকায় নেই। আমরা তো পেশার মধ্যে শ্রেণিবিন্যাস করি না। কে বড়, কে ছোট তা দেখি না। কেউ রাঁধুনি, কেউ পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কেউ আবার গুদামে কাজ করে, সবাই সমান শ্রম দিচ্ছে। আমাদের কাজ আরো কঠিন না করে বরং সহজ করা উচিত।’

তিনি আরো বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে।’

এই ইউনিয়ন কর্মীর মতে, ‘এই তালিকাটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজের মতো করে লিখে ফেলেছে। এর ফলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এমন অনেক সেক্টর বাদ গেছে যেখানে অনিয়মিত অভিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেমন পরিচ্ছন্নতা খাত, নির্মাণ খাতের বড় বড় প্রকল্প, রেস্তোরাঁ খাতের বেশ কিছু পেশা এবং লজিস্টিক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনেক পেশা। এর উদ্দেশ্য একটাই সেটি হচ্ছে এসব খাতে কাজ করা মানুষগুলোকে অনিয়মিত অবস্থাতেই রেখে দেয়া।’

তিনি দাবি করেন, যতটা সম্ভব কম সংখ্যক মানুষ বৈধতা পায়।

তবে যেসব পেশা ‘মেতিয়ের অঁ তনসিওঁ’ বা শ্রমিক সঙ্কটে থাকা তালিকায় নেই সেসব পেশায় কর্মরতরা এখনো মূলত এইএস ব্যবস্থার আওতায় বৈধতার জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে সম্প্রতি সার্কুলাস ভালস বাতিল করে নতুন সার্কুলার দেয়ার কারণ এই পদ্ধতিতে প্রেফেকচুরগুলোর বিবেচনার ক্ষমতা আরো বাড়ানো হয়েছে।

‘সার্কুলার ভালস’-এর আওতায় যেই সাধারণ কাঠামো ছিল, তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বহাল রয়েছে।

এসব বিষয় নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর অভিযোগ, সার্কুলার ভালস কজ কঠিন হয়ে পড়ার কারণে অনিয়মিত অভিবাসী শ্রমিকরা আরো বেশি মাত্রায় শোষণের শিকার হতে পারেন। অবৈধভাবে কাজ করানো, মজুরি না দেয়া, কাজের সুরক্ষা না থাকা ইত্যাদি পরিস্থিতি আরো প্রকট হবে। ইতোমধ্যেই এমন বহু উদাহরণ সামনে এসেছে এবং সেগুলো দিন দিন বাড়ছে।