৭৬ বছরের আন্দোলনের ফসল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৬ বছরে লক্ষ্যে ফেরার আশ্বাস

১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়ার শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুর নামক স্থানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান।

তাজমুল জায়িম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Location :

Kushtia
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। |নয়া দিগন্ত

বৃটিশ শাসনামলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মানসম্মত উচ্চশিক্ষার জন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম দাবি ওঠে ১৯০৩ সালে। কালের পরিক্রমায় এ অঞ্চলের আলেমদের সুদীর্ঘ ৭৬ বছরের আন্দোলনের পর কুষ্টিয়ার শান্তিডাঙা-দুলালপুরে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে সৎ ও দক্ষ নাগরিক তৈরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়টি। হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রতিষ্ঠার ৪৬ বছর পার করে ৪৭তম বর্ষে পদার্পন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। দীর্ঘ এ যাত্রায় অর্জনের খাতা ভারী হলেও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। তবে গণঅভ্যূত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মূল লক্ষ্যে ফেরানোর চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা।

৭৬ বছরের সুদীর্ঘ আন্দোলন

১৮৫৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখনে মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগ ছিল কম। এর ফলে ১৯০৩ সালে পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন ‘নবনূর’ পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ এমদাদ আলী, সৈয়দ আমীর আলী ও সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ। ১৯১২ সালে ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদসহ ঢাকায় একটি আবাসিক ‘মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠারও দাবি ওঠে। অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের দাবি মেনে নিয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কমিটি প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ অগ্রাহ্য করে শুধু ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। এদিকে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে বগুড়া জেলার বানিয়া পাড়ায় মওলানা আকরম খাঁকে সভাপতি এবং মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে জয়েন্ট সেক্রেটারী করে গঠিত ‘আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা’ আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও পূর্বের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের স্থানে শুধুমাত্র বিভাগ করায় এদেশের খ্যাতনামা আলেমগণ আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আবার সোচ্চার হন। ১৯২৯ সালে কলিকাতা আলীয়া মাদরাসায় জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ছাত্ররাও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। এরপর থেকে বহু কমিটি-কমিশন গঠিত হয়। এসব কমিটি ও কমিশন ১৯৬৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে পেশকৃত রিপোর্টে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সুপারিশ করে। একই বছর গভর্নর মোনায়েম খান প্রবল জনদাবির মুখে বরিশালের কাসেমাবাদে এবং ১৯৬৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ১৯৭৪ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারিভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারী ড. এম এ বারীকে সভাপতি করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা কমিটি গঠিত হয়। কমিটির রিপোর্টে উল্লিখিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যসমূহ হল— ‘কলা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইসলামী শিক্ষার সমন্বয় সাধন করা, নতুন আঙ্গিকে মাদরাসা শিক্ষা যুগোপযোগী করে এর উন্নতি সাধন করা, ইসলামী শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার ব্যবস্থা করা, দ্বি-মুখী শিক্ষা পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটিয়ে মুসলিম সমাজে ঐক্য স্থাপন করা, ইসলামী শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে অনৈসলামিক ও ইসলামী শিক্ষার বিরোধ অবসান করা, ইসলামী শিক্ষা এবং মানবিক ও বিজ্ঞান বিষয়ে পারদর্শী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এমন ছাত্র তৈরি করা যারা কর্ম জীবনে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি আস্থাশীল জনগণের আকাঙ্ক্ষা পুরণ করতে সক্ষম হবে।’ ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়ার শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুর নামক স্থানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান।

৪৬ বছরের লক্ষ্যচ্যুত যাত্রা

১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে দু’টি অনুষদের চারটি বিভাগে ৩০০ ছাত্র ভর্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাকাডেমিক যাত্রা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়টি অনুষদের অধীনে ৩৮টি বিভাগ রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অধ্যয়ন করছেন ১৯ হাজার ৮৯৭ জন শিক্ষার্থী। দেশী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বর্তমানে মোট ১৮ জন বিদেশী শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন তবে নানা সমস্যায় এ সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

প্রতিষ্ঠার ৪৬ বছরে শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধার জন্য আটটি হল নির্মিত হয়েছে। তবে এর পরেও ৭৫ শতাংশের বেশী শিক্ষার্থী রয়েছে আবাসন সুবিধার বাইরে। এদিকে চলমান মেগাপ্রকল্পের আওতায় ক্যাম্পাসে আরো চারটি আবাসিক হল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এ কাজ শেষ হয়ে আবাসন সংকট কিছুটা কাটবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

ইসলামী জ্ঞান ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে তা উপেক্ষিত। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আধুনিক জ্ঞানের পাশাপাশি ইসলামী জ্ঞানের সমন্বয়ের জন্য প্রত্যেক বিভাগে ইসলাম শিক্ষার ২০০ নম্বরের কোর্স রাখা হয়েছিল। এটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ছিল বলে দাবি শিক্ষার্থীদের। এদিকে বর্তমানে কোর্সগুলোকে সঙ্কুচিত করে ১০০ নম্বরের নন ক্রেডিট কোর্স রাখা হয়েছে। ফলে এর মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞানই অর্জন করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক ইসলামী জ্ঞানার্জনের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী সিলেবাসে ইসলামী কোর্স যুক্ত করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রতিষ্ঠিত আল-ফিকহ অ্যান্ড ল’ বিভাগে কৌশলে ইসলামী শিক্ষার পরিসরকে সঙ্কুচিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে ধর্মত্বত্ত ও ইসলাম শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সেকেন্দার আলী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ায় দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকে ওই দুটো বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আছে আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সে তালিকাতেও নেই। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ইসলামিক বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগগুলোতে শুধু ১০০ মার্কের ইসলামী স্টাডিজ কোর্স আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামিক নলেজ এবং জেনারেল নলেজের সমন্বয়ে সিলেবাস করা হয়। এদিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি অনুপস্থিত।’

ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটবে। কিন্তু এখানে আসার পরে দেখি, বিশ্ববিদ্যালয় যে ফ্যাকাল্টি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ‘থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ’ তার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দীর্ঘদিন ধরে তিনটি বিভাগ নিয়েই এ ফ্যাকাল্টি চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিউটে অনুমোদিত থাকলেও কয়েকটি ইসলামিক বিভাগ কার্যত চালু হয়নি। আমাদের লক্ষ্য, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এমন পাঁচটি বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা। এর ফলে ইসলামী স্টাডিজের একটি বড় শিক্ষার্থী গ্রুপ ও শক্তিশালী গবেষণা কাঠামো গড়ে উঠবে। এছাড়া মোট পাঁচটি রিসার্স সেন্টার চালু করা হবে।’