বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) পশুপালন ও ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে গত ৩১ আগস্ট জরুরি ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশুপালন, ভেটেরিনারি ও কম্বাইন্ড- এই তিনটি ডিগ্রি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
ওইদিন দুপুর ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনে তালা দেন আন্দোলনকারীরা। এতে ভিসি অধ্যাপক ড. এ. কে. ফজলুল হক ভূঁইয়াসহ সভায় উপস্থিত বিভিন্ন অনুষদের ২৫১ জন শিক্ষক ভেতরে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। পরে রাত ৮টার দিকে বহিরাগতরা এসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে তালা ভেঙে শিক্ষকদের উদ্ধার করেন।
অবরুদ্ধ ৮ ঘণ্টায় কী ঘটেছিল সেদিন অডিটোরিয়ামের ভেতরে?
এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের ব্যক্তিগত প্রোফাইলে পোস্ট দিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: মোখলেসুর রহমান এবং উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল।
অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: মোখলেছুর রহমান লেখেন, গত ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন এবং ভেটেরিনারী সায়েন্স অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের দাবির মুখে জরুরি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে যে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে, আমি তার একজন সাক্ষী হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ওই অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং নজিরবিহীন। মিটিংয়ের একেবারে শেষ পর্যায়ে একটি সুন্দর এবং আনন্দঘন পরিবেশ হঠাৎ করেই আতঙ্কে রূপ নেয়। ছাত্ররা মিলনায়তনের সবগুলো গেট তালা বন্ধ করে দেয় এবং মিছিল শুরু করে যে, শুধুমাত্র কম্বাইন্ড ডিগ্রি ছাড়া অন্য কোনো ডিগ্রি তারা মেনে নেবে না।
তিনি আরো লেখেন, রাত ৮টা পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে ছাত্র-ছাত্রীরা কারো কোনো কথাতেই কর্ণপাত করে নাই। ছাত্ররা আড়াই শ’ শিক্ষককে অভুক্ত রেখেছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সিনিয়র শিক্ষকবৃন্দ ক্ষুধায় এর ওর কাছে বিস্কুট আছে কিনা খোঁজাখুঁজি করেছে, উচ্চ রক্তচাপে এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সিনিয়র শিক্ষকবৃন্দ সময় মতো ওষুধ না পেয়ে একেবারেই নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন। অনেক শিক্ষিকা ভেতরে আটকা ছিলেন যাদের বাসায় ছোট বাচ্চা ছিল। আমি দুজন শিক্ষককে দেখেছি বাসায় তাদের অসুস্থ সন্তান রেখে এসেছিলেন, ভেতরে আটকা পড়ে সন্তানের দুশ্চিন্তায় তারা কাতর ছিলেন। কখন কোন ওষুধ খাবে সেটি ফোনে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলেন। আমাদের আড়াই শ’ শিক্ষকের পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, কখন আমরা বাসায় ফিরে যাব।
তিনি লেখেন, এমতাবস্থায় সন্ধ্যার পর শিক্ষক সমিতির জরুরি অধিবেশন শুরু হলে আমাদের একজন শিক্ষিকা সেন্সলেস হয়ে পড়ে যান। তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সও আসে। কিন্তু ছাত্ররা দরজা খুলে তাকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন এবং সিনিয়র প্রফেসরগণ ছাত্রদেরকে রিকোয়েস্ট করেন তারা যেন আমাদের অসুস্থ প্রফেসরকে হাসপাতালে নেয়ার সুযোগ দেন। ছাত্ররা কারো কথাই শুনছিল না। কী নৈতিক অধঃপতন আমাদের ছাত্রদের!
তিনি আরো লেখেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, ওই প্রফেসর অসুস্থ হয়ে মারা গেলেও দরজা খুলে বের করতে দেবে না। যা নিতান্তই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে আমি মনে করি। আমরা ছাত্রদের কাছে জিম্মি ছিলাম। অসুস্থ, সেন্সলেস প্রফেসরকে হাসপাতালে নেয়ার মতো কোনো অধিকার আমাদের ছিল না। অ্যাম্বুলেন্স উপস্থিত ছিল, কিন্তু ছাত্রদের অনুমতি ছিল না। হায় বাংলাদেশের সচেতন ছাত্রসমাজ! এমতাবস্থায় কে বা কারা দক্ষিণ দিকের দরজা ভেঙে আমাদের বের হওয়ার ব্যবস্থা করেন। ভাঙ্গা দরজা দিয়ে আমরা বের হয়ে যাই।
তিনি মন্তব্য করেন, ছাত্রদের এই সমস্ত ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছে। ছাত্রদের এই ঔদ্ধত্য, শিক্ষকদের প্রতি অবজ্ঞা, অশালীন মুখের ভাষা, আমাদের সকল শিক্ষককে দারুণভাবে পীড়া দিয়েছে। বাস্তব সত্য হলো, সারাদিনের খাদ্য এবং পানীয় বিহীন অভুক্ত শিক্ষকগণ গরমে ক্লান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অথচ কোনো মিডিয়াই শিক্ষকদের লাঞ্ছনার বিষয়টি প্রকাশ করছে না। শুধু বলছে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আক্রমণ।
পোস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মো: মোখলেছুর রহমান বলেন, আমি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মিটিংয়ে পুরোটা সময় ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলাম। আমি এবং তাহসিন ফারজানার ১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় ঢাকায় ফাইনাল প্রোজেক্টের ওয়ার্কশপ ছিল। আমি আবদ্ধ অবস্থায়, যদিও ক্ষুধার্ত ছিলাম, স্লাইডগুলো তৈরি করছিলাম। মনের ভেতরে কষ্ট অনেক। আমি যেটা নিজের চোখে দেখেছি, সেটা লিখেছি। আমরা সেখানে দুপুরে নুডুলস খেয়েছি। নরমালি ২০-৩০ টাকার যে নুডুলস দেয় সেটাই খেয়েছিলাম।
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল ফেসবুক পোস্টে লেখেন, সভায় সিদ্ধান্ত হয় ছাত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কম্বাইন্ড ডিগ্রি চালু হবে। একইসাথে আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করে দুটি অনুষদের নিজস্ব ডিগ্রিও সীমিত আকারে চালু থাকবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ খবর ছাত্ররা সভা শেষ হওয়ার পূর্বেই জেনে যায় (সম্ভবত তা ছাত্রদের মনঃপুত হয় নাই) এবং ছাত্ররা মিলনায়তনের গেটে তালা লাগিয়ে দেয়।
তিনি আরো লেখেন, সময় যত গড়িয়েছে, ততই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েন, একজন নারী শিক্ষক পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে যান। তবুও ছাত্রদের মন গলেনি। প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে এই অমানবিক পরিস্থিতি চলতে থাকে। মনে হচ্ছিল—শিক্ষকরা যদি অসুস্থতা কিংবা ক্ষুধা–তৃষ্ণায় মারা যান, তবুও দাবি না মানলে তারা বের হতে পারবেন না।
তিনি লেখেন, সবচেয়ে দুঃখজনক হলো—এই অসহায় শিক্ষকদের মুক্ত করতে কোনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অন্য ফ্যাকাল্টির ছাত্ররাও তাদের শিক্ষকদের সহায়তায় এগিয়ে আসেননি। অবশেষে তালা ভেঙে শিক্ষকেরা বের হতে পেরেছেন—এ যেন শুধু আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছু নয়।
ফেসবুকে পোস্ট বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন তিনি বলেন, এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমি শুধু ভেতরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছি। খারাপ লাগে আমাদের ছাত্ররা আমাদের বিরুদ্ধে যখন যায়।
দরজা খুলে দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার এই বিষয়ে স্পষ্ট জানা নেই কে খুলেছে। প্রশাসনের বিবৃতি অনুসারে বলা হয়েছে, তাদের স্বজনরা দরজা খুলেছে, আমার মনে হয় প্রশাসনের বক্তব্য বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত।
ওই দিন কী ঘটেছিল জানতে চাইলে পশুপালন অনুষদের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শিবলী সাদী বলেন, দুপুরেও নারী শিক্ষকসহ যাদের ইমারজেন্সি সমস্যা তাদের বাইরে বের করার ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় দুপুরে অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের মুক্তা ম্যাম, হাফিজা ম্যাম, ফার্মাকোলজি বিভাগের ফাতেমা ম্যাম, ফিজিওলজি বিভাগের শারমিন ম্যাম এবং পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনিস্টিটিউটের বাতেন স্যারকে বাইরে বের করা হয়। পাশাপাশি ইমারজেন্সি সমস্যা হলে দ্রুত সলভ করার জন্য আমরা নিজেরাই গেটে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসি।
তিনি আরো বলেন, আর সন্ধ্যার সময়ও একজন ম্যাম অসুস্থ হওয়ায় তাকে বাইরে আনার জন্য চাবি নিয়ে আমরা গেটে উপস্থিত হই। তখন এসপি স্যারও উপস্থিত ছিলেন। ঠিক তখনই পেছনের গেট ভাঙা বা তালা খোলার ব্যবস্থা করা হয়। ওই গেট দিয়ে তখন প্রায় সকল শিক্ষক বের হন।
খাবারের বিষয়ে ওই শিক্ষার্থী বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্যারদের জন্য পর্যাপ্ত পানির বোতল ও শুকনো খাবার সরবারহ করে অডিটোরিয়ামের ভেতরে।