ডাকসু নির্বাচনের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখগুলোয় ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে সেনাবাহিনীকে রাখার ঘোষণা নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। রাজনীতিবিদরা বলছেন, সামরিক শাসনামলেও এরকম সিদ্ধান্ত নিতে দেখেননি তারা।
অতীতে জাতীয় নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন করতে দেখা গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন’।
এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের কারো সাথে আলোচনা করা হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন প্রার্থীরা। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
‘আমাদের কারো সাথে কথা বলে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ইন্টারনাল (অভ্যন্তরীণ) ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনী কেন মোতায়েন করা হবে, সেটাও আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটা প্রচণ্ড রকমের লজ্জাজনক একটা ব্যাপার,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ডাকসু নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী উমামা ফাতেমা।
একই অভিযোগ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনের আরেক প্রার্থী সাদিক কায়েমও। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তো উচিত অবশ্যই অংশীজনদের সাথে আলাপ করা। কিন্তু কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই এগুলো দেয়া হচ্ছে।’
নির্বাচনের দিন সেনা মোতায়েনের আকস্মিক ঘোষণায় ডাকসু’র সাবেক নেতারাও বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন।
ডাকসু’র সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা স্পর্শকাতর জায়গায়, যেখানে সেনাদের সাথে ছাত্র সংঘর্ষের নজির রয়েছে, সেখানে এমন একটি সিদ্ধান্ত কিভাবে নেয়া হলো?’
মান্না সত্তর ও আশির দশকে সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, দেখেছেন সামরিক শাসন। এর মধ্যেই ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে দুই-দু’বার নির্বাচিত হয়েছেন ভিপি। তিনি বলেন, ‘তখনকার সামরিক সরকারের সময়েও তো আমরা এরকম সিদ্ধান্ত নিতে দেখিনি। এমনকি পুলিশকে পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয়া হতো না।’
আশির দশকের শেষদিকে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন মুশতাক হোসেন।
তিনিও ক্যাম্পাসে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে তার মতামত তুলে ধরেন।
‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের। অতীতে সেভাবেই ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। এর জন্য সেনা মোতায়েনের কোনো প্রয়োজন নেই, সেরকম কোনো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে সেনা উপস্থিতির পরিণতি কী হতে পারে, সেটা অতীতে আমরা দেখেছি। এবারো যে আগের মতো অঘটন ঘটবে না, সেটার নিশ্চয়তা কে দেবে?’
‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার যে ঘোষণা মঙ্গলবার দেয়া হয়েছে, সেটির বিষয়ে যে ভোটার কিংবা প্রার্থীদের মতামত নেয়া হয়নি, তা স্বীকার করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও।
যদিও তারা দাবি করেছে যে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে।
‘ছাত্র-ছাত্রী এবং অংশীজনদের সাথে আগে বিভিন্ন সময় যখন আমরা আলাপ করেছি, তখন তারা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। তখন আমরা বলেছিলাম যে তাদের নিরাপত্তায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ডাকসু নির্বাচনে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
‘সেই প্রতিশ্রুতি ও শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনুযায়ীই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
তবে শিক্ষার্থীরা না চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, তাদের কথা ভেবেই আমরা বিএনসিসি ও পুলিশের পাশাপাশি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীর রাখার ঘোষণা দিয়েছি। এখন তারা যদি প্রয়োজন মনে না করে তাহলে সেনাবাহিনী থাকবে না।
তিন স্তরের নিরাপত্তা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের আট ভোটকেন্দ্রে তিন স্থরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এর মধ্যে প্রথম স্তরে থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি সদস্য ও প্রক্টরিয়াল টিম। দ্বিতীয় স্তরে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন থাকবে।
তৃতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশমুখে সেনাবাহিনী 'স্ট্রাইকিং ফোর্স' হিসেবে অবস্থান করবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
প্রয়োজন অনুযায়ী, সেনাবাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবে এবং ভোট শেষে ফলাফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র কর্ডন করে রাখবেন সেনা সদস্যরা।
মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থীদের সাথে অনুষ্ঠিত এক সভায় এসব কথা জানিয়েছেন ডাকসু নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বরাত দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তারা জানান, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। ইতোমধ্যে টহল টিমসহ সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো সক্রিয় রয়েছে।
নির্বাচনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ রাখার পাশাপাশি ভোটারদের জন্য অতিরিক্ত বাস ট্রিপ দেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে আবাসিক হলে কোনো বহিরাগত থাকতে পারবে না। নিয়মিত টহল পরিচালনার মাধ্যমে এ ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে।
তবে ছাত্রীদের হলগুলোতে কখনোই বহিরাগতরা থাকতে পারেন না।
নির্বাচনের আগের দিন ৮ সেপ্টেম্বর ও নির্বাচনের দিন ৯ সেপ্টেম্বর মেট্রোরেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন বন্ধ থাকবে। নির্বাচনের দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পুরোপুরি সিলগালা থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এতে।
এছাড়া বৈধ শিক্ষার্থী, অনুমোদিত সাংবাদিক ও নির্বাচন পরিচালনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে না বলেও আজকের বৈঠকে জানানো হয়েছে।
একই সাথে যেসব শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন, তাদের ভোট দেয়ার জন্য বিভিন্ন রুটে বাসের অতিরিক্ত ট্রিপের ব্যবস্থা করা হবে। এসব বাস নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা দেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
সভায় নিরাপত্তা সংক্রান্ত এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো প্রার্থী দ্বিমত পোষণ করেননি বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যদিও বাস্তবে সেটি দেখা যাচ্ছে না। ভোটার ও প্রার্থীদের সাথে আলোচনা না করে সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করেছেন প্রার্থীরা।
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, ‘আলোচনা ও সবার মতামত না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তের আমরা নিন্দা জানাই। আমরা দাবি জানাচ্ছি যেন সিদ্ধান্তটি দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।’
সূত্র : বিবিসি