নারী শিক্ষার্থীকে ইভটিজিং

যবিপ্রবি শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সংঘর্ষে আহত ৩০

যবিপ্রবি’র এক নারী শিক্ষার্থীকে ইভটিজিংয়ের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন সাংবাদিকসহ ২৭জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

যবিপ্রবি প্রতিনিধি

Location :

Jashore
যবিপ্রবি শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সংঘর্ষে আহত ২৭
যবিপ্রবি শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সংঘর্ষে আহত ২৭ |নয়া দিগন্ত

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) এক নারী শিক্ষার্থীকে ইভটিজিংয়ের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন সাংবাদিকসহ ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এম আর খান মেডিক্যাল সেন্টারে, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট যশোর সদর হাসপাতালে ও চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে বুধবার (২৬ নভেম্বর) সকালে অভিযুক্ত সেই ইভটিজারকে আটক করে যৌথবাহিনী।

মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ আমবটতলা বাজার নামক স্থানে এ সংঘর্ষের ঘটনা শুরু হয়।

ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘গত ২৪ নভেম্বর আমি ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে কাজ করার জন্য আমবটতলার ইলেকট্রনিক্স দোকানে রাত ৮টার দিকে যাই। তখন সেই দোকানে ইলেকট্রিক ওয়্যার খুলতে ছিলাম। ভুলবশত আমার হাত হালকা কেটে যায়, কিন্তু আমি সেই দিকে খেয়াল করি না। দোকানদার আমার হাত জোরপূর্বক টেনে নেয় এবং ওষুধ লাগানোর চেষ্টা করে। এরপর আমি আমার কাজ শেষ করে দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। তখন সে আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করে এবং অশালীন কথাবার্তা শুরু করে। কথাগুলো এমন ছিলো ‘আপনার জীবনে কোনো কষ্ট আছে কিনা? আপার হাত কেটে গেছে, কোনো অনুভূতি নেই। আপনার বাসা বরিশালে কিনা? আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে? তা থাকলে তো তাদের জীবন তো শেষ।’ এসব কথা শোনার পর আমি রেগে যাই। তা দেখে সে আরো মজা নিতে থাকে। আমি সেখান থেকে দ্রুত টাকা দিয়ে বের হয়ে যেতে চাইলে সে বলে— ‘টাকা দিতে হবে না, আপনি আরো ব্যাটারি নিয়ে আসেন, আমার সামনে বসে ব্যাটারি খুলেন, আমি দেখি। আমি আপনাকে আমার পকেট থেকে টাকা দিচ্ছি।’ আমি তার এই অশালীন কথা শুনে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলাম, তখন সে আমাকে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে এবং শুভরাত্রি বলে।’

এ বিষয়ে কেমিকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির বলেন, আমাদের এক জুনিয়র ছাত্রীকে একজন দোকানদার অশালীন ভাষায় যৌন হয়রানি করে। বিষয়টি জানতে পেরে আমরা কয়েকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তখন ছাত্রীটি কেঁদে বলে যে দোকানদার তার সাথে অসভ্যভাবে কথা বলেছে। আমরা তাকে অনুরোধ করি আমাদের ছোট বোনের কাছে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার বদলে তিনি বাজার কমিটির কয়েকজনকে ডেকে আমাদের মারধর করে। এতে আমি, আমার জুনিয়র ও ব্যাচমেট সবাই আহত হই। কোনোভাবে আমরা সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসি। বিষয়টি তাৎক্ষণিক প্রক্টর এবং ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দফতরের পরিচালককে ফোন করলেও কোনো সহায়তা পাইনি।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয়দের ধাওয়া পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংবাদ সংগ্রহের সময় ছোঁড়া ইটপাটকেলে আহত হন ডেইলি ক্যাম্পাসের সাংবাদিক জহুরুল ইসলাম ও রাইজিং বিডির সাংবাদিক ইমদাদুল ইসলাম। এছাড়াও সাংবাদিকদের ফোন কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে উত্তেজিত জনতা, একপর্যায়ে সাব্বির হোসেন নামের আরেক সাংবাদিকের সাইকেল ভেঙ্গে পুড়িয়ে দেয় তারা।

এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডি চেষ্টা করলেও তারা ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে এ সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। সংঘর্ষের তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপর চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা।

সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি), কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন। পরবর্তীতে রাত ৯টার পরে সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশের যৌথবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

এরপর আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কোষাধ্যক্ষসহ আরো অনেকে। সেসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সময়মতো ঘটনাস্থলে উপস্থিত করতে না পারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের দাবিতে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে প্রক্টর ড. মো: ওমর ফারুক বলেন, ‘একটি ছাত্রীকে ইভটিজিং করাকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ ঘটে। আমাদের প্রক্টরিয়াল বডিসহ অনেক শিক্ষক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছি, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসতে দেরি করায় পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। সংঘর্ষে আমাদের বেশ কিছু শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীদের একাংশ ভিসি স্যারকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। ভিসি স্যারের নিকট শিক্ষার্থীরা ৬টি দাবি তুলে ধরেন। পরবর্তীতে সবগুলো দাবি পূরণের আশ্বাস দেন এবং আসামিকে গ্রেফতার করা নিশ্চিত করেন।’

ঘটনা প্রসঙ্গে যবিপ্রবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আব্দুল মজিদ বলেন, ‘ঘটনাটি আমি সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে জানতে পারি। বিষয়টি জানার সাথে সাথে আমি এসপি, জিওসি, র‍্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করি। তারা বিষয়টি শোনেন ঠিকই, কিন্তু আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো তাৎক্ষণিক সহযোগিতা পাইনি। পুলিশের সময়মতো হস্তক্ষেপ পেলে সংঘর্ষ এত বড় আকার ধারণ করত না। দুঃখজনকভাবে, পুলিশ দেরিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পরও তারা সক্রিয়ভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। পুলিশের সহযোগিতার অভাবেই ঘটনা বড় হয়েছে। পুলিশের ভূমিকায় আমরা হতাশ। পুলিশের এমন দায়িত্বহীনতায় দেশের সার্বিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। পাশাপাশি ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাজার কমিটির সাথে জরুরি বৈঠকে বসবো, যাতে এমন বিরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে।’

অভিযুক্ত মো: মোনায়েম হোসেন বলেন, ‘সংঘর্ষের আগের দিন ওই মেয়ে আমার দোকানে এসেছিলো ব্যাটারি ঠিক করতে। সে আমার কাছ থেকে টুলস নিয়ে ব্যাটারি কাটতে গেলে সে হাতের আঙ্গুল সামান্য কেটে ফেলে। পরে আমি তাকে ইঞ্জেকশন নিতে বলি আর তাকে বলি আপনার বয়ফ্রেন্ড বা কোনো বন্ধু থাকলে তাকে ডেকে আনেন। পরবর্তীতে আজকে সন্ধ্যায় আমার দোকানে ওই মেয়েসহ তার কয়েকজন বন্ধুদের ডেকে আনে। তারা আমাকে শার্টের কলার ধরে জিজ্ঞেস করে আমি ইভটিজিং করি কিনা এই বলে তারা আমাকে মারধর শুরু করে। পরে আমি দোকান মালিকদের ডেকে আনলে তারা পালিয়ে যায়। এরপরে ঘটনা এই পরিস্থিতিতে এসে পড়ে।

তবে আমবটতলা বাজার ও আশেপাশের এলাকাবাসীদের কেউ সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।

এ ঘটনায় বুধবার (২৬ নভেম্বর) যশোর কোতোয়ালী থানায় বাদি হয়ে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে আসামি মো: মোনায়েম হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের উপ-পরিদর্শক দেবাশীষ হালদার বলেন, ‘ইভটিজিংয়ে অভিযুক্ত মো: মোনায়েম হোসেনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বাদি হয়ে মামলা করেছেন। আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি এবং কোর্টে চালান করে দিয়েছি। এখন তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।