সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়ন নাকি সেলফ স্কিল—কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- দীর্ঘ দিন এই বিরাট সংখ্যক কওমি শিক্ষিতরা সরকারের নজরে ‘অশিক্ষিত’ ছিলেন।

বেলায়েত হুসাইন

২০২২ সালের সরকারি একটি হিসাব অনুযায়ী—দেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ১৯ হাজার ১৯৯টি। তবে হিসাবের বাইরেও আরো কিছু মাদরাসা রয়েছে। সবমিলিয়ে সারাদেশে মোট কওমি মাদরাসার সংখ্যা ২০ হাজারের চেয়েও বেশি হতে পারে।

আর কওমি মাদরাসাগুলোর সম্মিলিত শিক্ষাবোর্ড আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে অন্তত ২৮৮৫টি দাওরায়ে হাদীস মাদরাসা রয়েছে। সংস্থাটি নয়া দিগন্তকে জানিয়েছে, সর্বশেষ ১৪৪৬ হিজরি শিক্ষাবর্ষে এসব মাদরাসা থেকে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ৩২ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী।

উপরের পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয় যে, দেশের বড় একটি সংখ্যক জনগোষ্ঠী কওমি মাদরাসার শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- দীর্ঘ দিন এই বিরাট সংখ্যক কওমি শিক্ষিতরা সরকারের নজরে ‘অশিক্ষিত’ ছিলেন। মানে তাদের শিক্ষার কোনো স্বীকৃতি ছিল না। অবশেষে, নানা ঘটনার পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে তৎকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদান করে।

ওই ঘোষণায় বলা হয়, ‘কওমি মাদরাসার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ও দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে মাস্টার্সের (ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবি) সমমান প্রদান করা হলো।’ এই ঘোষণার পর প্রায় ৮ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কওমি সনদের বাস্তবিক কার্যকারিতা শুরু হয়নি। মানে এই সনদ শুধু নামেই, বলতে গেলে তা উল্লেখযোগ্য কোনো কাজে আসছে না।

বিগত সময়ের মধ্যে একাধিকবার কেউ কেউ স্বীকৃতি বাস্তবায়নের দাবি ওঠালেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে কওমি আলেমদের অনেকে অভিমান করে বলতে চাইছেন যে, আসলে আমাদের স্বীকৃতির পেছনে পড়ে লাভ নেই; বরং শিক্ষার্থীদের ‘সেলফ স্কিল’ বা নিজস্ব যোগ্যতা বৃদ্ধি করায় মনোযোগী হতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতে মেধাবী কওমি আলেম ও নুরুল কুরআন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা আবদুল্লাহ আল মাসউদ নয়া দিগন্তকে বলেছেন, আসলে আমি আমি মনে—সনদের কার্যকারিতা ও সেলফ স্কিল—দুটিই সমান গুরত্বপূর্ণ। মূলত সেলফ স্কিলের সাথে যদি স্বীকৃতিটাও থাকে, তাহলে বাড়তি কিছু এডভান্টেজ পাওয়া যায়। দেখা যায়, অনেক স্কিল অর্জন করার পরেও কিছু ক্ষেত্রে সেই স্কিলকে ভালোভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না স্বীকৃতির কার্যকারিতা না থাকার কারণে। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্কিল অর্জনের জন্যও স্বীকৃতির দরকার হয়।’

তিনি বলেন, উন্নত শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন ছাড়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া স্বীকৃতি পাওয়া ও এর যথাযথ বাস্তবায়নটা তো কওমি মাদরাসার ছাত্রদের নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্র যেটা থেকে তাদেরকে যুগের পর যুগ বঞ্চিত করে রেখেছে। ব্যক্তি জীবনে সেই স্বীকৃতি কার কতটুকু কাজে আসবে—এটা হলো পরের ব্যাপার, রাষ্ট্রের উচিত তার নাগরিকদের প্রতি এই বৈষম্য পরিহার করা।

মাওলানা আবদুল্লাহ আল মাসউদ আরো বলেন, পাশাপাশি কওমি শিক্ষার্থীদের উচিত, কেবল স্বীকৃতির কার্যকারিতার দিকে না তাকিয়ে থেকে বিভিন্ন স্কিল অর্জন করার মাধ্যমে নিজেকে যেন যোগ্য করে তোলা যায়, সে চেষ্টা অব্যাহত রাখা। যাতে স্বীকৃতির বাস্তবায়ন না হলেও তাদেরকে আটকে থাকতে না হয়। কারণ, স্কিল ভালো হলে অনেক জায়গাতেই স্বীকৃতির বাস্তবায়ন ছাড়াই ভালো কিছু করা সম্ভব। গ্লোবালাইজেশন ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে সনদ ছাড়াও উন্নতি করার বহু রাস্তা খোলা আছে। এজন্য শুধু ভালো স্কিল অর্জনেও সাফল্য পাওয়া সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগ মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস সম্পন্নকারী ও ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার বর্তমান শিক্ষার্থী মাওলানা ইফতেখার জামিলও প্রায় অভিন্ন মত দিয়েছেন। নয়া দিগন্তকে তিনি বলেছেন, ‘কওমি মাদরাসার স্বীকৃতির বাস্তবায়ন ও সেলফ স্কিল দুইটাই আলাদা আলাদা জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ। আর স্বীকৃতির বাস্তবায়ন যে শুধু কওমি পড়ুয়াদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, ব্যাপারটি তেমন নয়; বরং যোগ্য ধর্মীয় লোকবল তৈরির জন্যও রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের সনদের বাস্তবায়ন করা, যেগুলোর মাধ্যমে তারা দেশ-বিদেশে পড়াশোনা করার পাশাপাশি নানা অবদানও রাখতে পারবেন।’

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক না থাকলেও অনেক কিছুতে কন্ট্রিবিউট করা যায় না। এজন্য এভাবে রাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে জ্ঞান চর্চা করা অনেক কঠিন। রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি থাকলেও আলোচনা সাপেক্ষে সেটা সমাধান করা। কারণ, নাগরিক হিসেবেও রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রাখা জরুরি।’

মাওলানা ইফতেখার জামিল মনে করেন, রাষ্ট্র যদি কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়ন করেও, তাহলেও যে খুব আহামরি কিছু হবে, তেমনটি না। তিনি বলেন, ‘বরং এমনটি যদি সত্যিই ঘটে, তাহলে দেখা যাবে কওমি আলেমদের শতকরা সর্বোচ্চ ২০-২৫ জন সরকারি সুবিধা নিতে পারেন, বাকিরা বর্তমান যেভাবে কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত, সেভাবেই থাকবেন।’ এজন্য সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়ন হোক আর না হোক, কওমি পড়ুয়ারা যেন নিজেদের সেলফ স্কিল বৃদ্ধিতে কোনো আপস না করেন—সে বিষয়ে জোর দিয়েছেন মাওলানা ইফতেখার জামিল।

আর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো কেন স্বীকৃতির বাস্তবায়ন হয়নি—এ বিষয়ে জানতে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ কওমি ছাত্র ফোরামের সভাপতি মাওলানা জামিল সিদ্দিকীর সাথে। তিনি এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। নয়া দিগন্তকে তিনি বলেছেন, ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে বৈষম্যহীনতার প্রতিশ্রুতি থাকলেও কওমি শিক্ষার্থীরা এখনো সেটা অনুভব করতে পারছেন না। স্বীকৃতির ঘোষণা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এর পেছনে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও ব্যর্থতা কম নয়।’

একজন কওমি আলেম হিসেবে আত্মসমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘কওমি অঙ্গনে এখন পর্যন্ত একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি, যারা কওমি জনতার যৌথ দাবি সুসংগঠিতভাবে উপস্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে মাদরাসাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে সমন্বয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি বহু বছর ধরে কওমি মহল ‘অরাজনৈতিক’ পরিচয়ে গর্বিত থেকেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অন্যরা যখন রাজনৈতিকভাবে নিজেদের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসে, আমরা তখন নীরব দর্শক হয়ে থাকি।’

একইসাথে কওমি মাদরাসার বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতন তরুণদের উপেক্ষা করার বিষয়টিও উল্লেখ করেন মাওলানা জামিল সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘মেধাবী তরুণ কওমি শিক্ষার্থীদের যারা আধুনিক ভাষা ও ভাবনায় সনদের দাবি তুলে ধরতে পারতেন, তারা মূল নেতৃত্বের পরিসরে জায়গা পাননি। ফলে দাবিগুলো কেবল আবেগ বা বক্তৃতা পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।’ এজন্য একটি সর্বজনীন কওমি ঐক্য মঞ্চ গঠন করে এসব সঙ্কট সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানান তিনি।

কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে সাম্প্রতিক কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা—এ বিষয়ে জানতে চাইলে আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়ার স্থায়ী কমিটির সদস্য মাওলানা মাহফুজুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘স্বীকৃতি বাস্তবায়ন বিষয়ে আগে থেকেই আল হাইয়ার একটি সাব কমিটি গঠিত আছে। হজের আগে ধর্ম উপদেষ্টার সাথে স্বীকৃতি বাস্তবায়নের বিষয়ে কমিটির একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে—ধর্ম উপদেষ্টার সমন্বয়ে খুব শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে সাব কমিটি শিক্ষা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক করবে। আশা করি সেখানে ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত আমরা পাবো।’