শিক্ষক সঙ্কটে ক্লান্ত নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রয়োজন ছিল অন্তত ৫৪০ জন সক্রিয় শিক্ষক। কিন্তু বাস্তবে আছেন মাত্র ২২০ জন, যাদের অনেকেই শিক্ষাছুটিতে, ফলে বাস্তবে শিক্ষক সংখ্যা আরো কম।

এস এম মোজতাহীদ প্লাবন, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় |নয়া দিগন্ত

বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মতো ছড়িয়ে থাকা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রতিদিন ভোর হয় জ্ঞানচর্চার আশায়। কিন্তু প্রভাতী আলোয় যখন শ্রেণিকক্ষে বসে সহস্র শিক্ষার্থী, তখন দেখা মেলে না পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষকের মুখ।

চিরপ্রভাতের মতো আলোকিত হওয়ার কথা ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা-আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার কথা ছিল প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ, প্রতিটি মন। কিন্তু বাস্তবতা যেন এক দীর্ঘশ্বাসে ডুবে থাকা বিষণ্ণ সকাল, যেখানে শিক্ষক নেই, ক্লাসরুম নিঃসঙ্গ, আর উচ্চশিক্ষা পথ হারিয়েছে শিক্ষকের অভাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫ সালের ডায়েরি অনুযায়ী, বর্তমানে ১০ হাজার ৮০৯ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত (২০২৪-২৫ সেশন বাদে)। আদর্শ অনুপাতে প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজন একজন শিক্ষক। অর্থাৎ প্রয়োজন ছিল অন্তত ৫৪০ জন সক্রিয় শিক্ষক। কিন্তু বাস্তবে আছেন মাত্র ২২০ জন, যাদের অনেকেই শিক্ষাছুটিতে, ফলে বাস্তবে শিক্ষক সংখ্যা আরো কম। এই হিসাব যেন শুধুই সংখ্যা নয়, একেকটি শূন্যতা, একেকটি অপ্রাপ্তির দীর্ঘ ছায়া।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) চাইছে, ‘আউটকাম বেইজড এডুকেশন (ওবিই)’ বাস্তবায়ন। যেখানে প্রতিটি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠদান, থিসিস, গবেষণা ইত্যাদি মিলিয়ে প্রয়োজন ৩০-৩২ জন সক্রিয় শিক্ষক। থিসিস না থাকলেও ওবিই ছাড়াও বর্তমান সিলেবাস অনুসরণ করতে গেলেও প্রয়োজন পড়ে অন্তত ১৫-১৬ জন শিক্ষক। কিন্তু এই সংখ্যাটা যেন বহু বিভাগের স্বপ্নও নয়, কোথাও শিক্ষক মাত্র তিন থেকে সাতজন, কোথাও নেই প্রয়োজনীয় স্টাফও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে চারজন, পপুলেশন সায়েন্স বিভাগে বর্তমানে তিনজন, ফোকলোর বিভাগে ছয়জন, ইতিহাস বিভাগে তিনজন, মার্কেটিং বিভাগে চারজন, দর্শন বিভাগে চারজন, নৃবিজ্ঞান বিভাগে চারজন, পরিসংখ্যান বিভাগে তিন জন শিক্ষক পাঠদান করছেন।

এই স্বল্পতায় শুধু শিক্ষকের কণ্ঠরোধ হয় না, ব্যাহত হয় জ্ঞানচর্চা। পাঠ না পেয়ে হতাশ শিক্ষার্থী, দিশেহারা হয়ে ফিরে যায়। নেই পর্যাপ্ত ক্লাস, নেই নার্সিং, নেই প্রজ্ঞার সাহচর্য।

ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী তকিব হাসান বলেন, ‘অ্যাকাডেমিক গুণগত মান রক্ষায় শিক্ষক সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ। ফোকলোর বিভাগের পাঠদানে গুণগত মান ধরে রাখতে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ অপরিহার্য। বর্তমানে যে শিক্ষক সংখ্যা আছে, তা ছয়টি ব্যাচের জন্য পর্যাপ্ত নয়। বিভাগীয় অগ্রগতি ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে অবিলম্বে অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানাই আমরা।’

পপুলেশন সায়েন্সে বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাওন বলেন, ‘আমাদের বিভাগে বর্তমানে শিক্ষক তিনজন। স্যাররা সংখ্যায় কম হওয়ায় একসাথে অনেক কোর্স নিতে বাধ্য হন, ফলে ক্লাসের মানও কমে যায়। পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্লাস না নিয়েই কোর্স শেষ করতে হয়। যথাযথ সময়ে সেমিস্টার পরীক্ষাও হচ্ছে না, সেশনজট বাড়ছে। এই সঙ্কটে আমরা শুধু সনদ নিচ্ছি, কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। প্রশাসনের উচিত দ্রুত যোগ্য স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা এবং শিক্ষিত বেকার তৈরি হওয়া বন্ধ করা।’

অন্যদিকে, অল্পসংখ্যক শিক্ষক-স্টাফকে নিতে হয় অতিরিক্ত চাপ। ক্লান্তির ছায়া পড়ে দৃষ্টিতে, জন্ম নেয় ফাঁকি দেয়ারও অজুহাত। শিক্ষা তখন আর আলো নয়, বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মুহাম্মদ শামসুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমার বিভাগসহ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিভাগের মধ্যে শিক্ষকের প্রবল সঙ্কট রয়েছে। একজন শিক্ষককে একাধারে ক্লাস পরিচালনা, পাঠ্যক্রমের প্রস্তুতি, খাতা দেখা, প্রশ্ন তৈরি, মানসম্মত প্রবন্ধ প্রকাশ করা, অ্যাকাডেমিক এবং প্রশাসনিক বিভিন্ন মিটিং এবং এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মতো নানা দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় জনবল যদি বিভাগে না থাকে তাহলে যেমন শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়, একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি) প্রস্তাবিত আউটকাম বেসড এডুকেশন (ওবিই) বাস্তবায়ন করাও খুবই কষ্টসাধ্য।’

তিনি আরো বলেন, ‘মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে এবং বর্তমান সঙ্কট সমাধানের জন্য অবিলম্বে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও জনবল নিয়োগ সময়ের অপরিহার্য দাবি বলে মনে করছি।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু ডিপার্টমেন্ট শিক্ষক সঙ্কটে আছে। তাদের গুণগত শিক্ষা প্রদান করতে গিয়ে স্বল্প সংখ্যক শিক্ষকের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ বিষয়ে ইউজিসিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। গতকালও তাদের সাথে কথা বলে এসেছি। আশ্বাস দিয়েছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিষয়টি তারা গুরুত্বের সাথে দেখবেন।’