অস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়েই বেলেমে শুরু কপ৩০

জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগে ঐকমত্য এখনো দূরের স্বপ্ন

যেখানে যোগ দিয়েছেন ১৯০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধি, জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, এনজিও ও গণমাধ্যমকর্মী।

সংগৃহীত

কাওসার আজম, ব্রাজিল থেকে

বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সংকটের মধ্যে শুরু হয়েছে জাতিসঙ্ঘের ৩০তম জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন—কপ৩০।

সোমবার (১০ নভেম্বর) স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় এবং বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় ব্রাজিলের আমাজন নগরী বেলেমে উদ্বোধন হয় দুই সপ্তাহব্যাপী এই বৈশ্বিক সম্মেলনের। যেখানে যোগ দিয়েছেন ১৯০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধি, জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, এনজিও ও গণমাধ্যমকর্মী।

তবে উদ্বোধনের দিনই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ও আলোচ্য বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসা, অর্থায়ন ও অভিযোজন পরিকল্পনা—এই তিনটি ইস্যু ঘিরে দেশগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে।

কপ৩০ শুরু হলেও এখনো স্পষ্ট নয়—দেশগুলো ঠিক কোন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে। ২০২৩ সালে দূষণকারী জ্বালানি ধীরে ধীরে বন্ধ করার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সেটির অগ্রগতি খুবই সীমিত। পরিস্থিতি জটিল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের ঘোষণায়; তারা ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও জ্বালানি নিরাপত্তা সংকটে উচ্চাভিলাষী জলবায়ু লক্ষ্য কিছুটা শিথিল করেছে। ফলে, এবারের সম্মেলনে নতুন বৈশ্বিক চুক্তি আদৌ সম্ভব হবে কিনা—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এবারের কপ৩০-এর সভাপতি ব্রাজিলের কূটনীতিক আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো বলেছেন, ‘আমার পছন্দ হলো—সব সময় কোনো আনুষ্ঠানিক কপ সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই। যদি দেশগুলো সত্যিই ঐকমত্যে পৌঁছাতে চায়, আমরা সেটি নিয়ে কাজ করব।’

তিনি আরো বলেন, ‘চীন এবারে এক নতুন ভূমিকায় এসেছে—সমাধান প্রদানকারী দেশ হিসেবে। সাশ্রয়ী সবুজ প্রযুক্তির মাধ্যমে চীন এখন বৈশ্বিক জ্বালানি রূপান্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন চীন অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে, কিন্তু বাস্তবে এটি জলবায়ুর জন্য ইতিবাচক।’

কপ৩০ শুরু হওয়ার আগের দিন, গত রোববার সন্ধ্যায়, ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা নৌযাত্রা করে বেলেমে পৌঁছায়। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়ে তারা আমাজন উপত্যকা থেকে এসেছেন, বন ও ভূমি রক্ষার দাবি নিয়ে।

তারা বলছেন, ‘আমরা চাই নেতারা প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব পদক্ষেপ নিন। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব আমাদের ওপরেই পড়ছে—বন ধ্বংস, নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়া, অবৈধ খনন—এসব আমাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে।’

তাদের দাবি, বন ব্যবস্থাপনা ও ভূমি সিদ্ধান্তে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

কপ৩০ শুরুর আগে জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের তিন শ’র বেশি বিজ্ঞানী এক যৌথ চিঠি প্রকাশ করেন। তারা সতর্ক করেন—‘পৃথিবীর বরফাচ্ছন্ন অঞ্চলগুলো ভয়াবহ গতিতে গলছে। এটি শুধু পরিবেশ নয়, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় হুমকি। স্বল্পমেয়াদি জাতীয় স্বার্থ যেন কপ৩০ আলোচনাকে প্রভাবিত না করে।’

অ্যাজেন্ডা অনুমোদনে মতবিরোধ

জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম কাজ হলো এজেন্ডা অনুমোদন, যা নিয়েই মাসের পর মাস ধরে মতবিরোধ চলছে।

কপ৩০’র সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো বলেছেন, ‘এটি দেশগুলোর অগ্রাধিকারের এক স্বাস্থ্যকর বিনিময়। তবে আমরা চাই এটি ফলপ্রসূ হোক।’

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা আশা প্রকাশ করেছেন যে এবারের কপ অন্তত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার একটি পরিকল্পনা নির্ধারণ করবে।

তিনি বলেন, ‘কীভাবে এটি করা হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। সেটিই কপ৩০-এর সবচেয়ে বড় রহস্য।’

প্রথমবার কৃষি খাত আসছে আলোচনায়

এবারের কপে একটি নতুন দিক হচ্ছে—কৃষি খাত থেকে নির্গমন হ্রাস। দীর্ঘদিন এটি আলোচনায় উপেক্ষিত ছিল, কারণ কৃষি ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদন অনেক দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন কৃষি প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে নির্গমন কমানোর সমাধান খুঁজছে। এই খাতেও আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানো দরকার।

অর্থায়নে বৈষম্য নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষোভ: উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোগ, জলবায়ু অভিযোজনের জন্য ধনী দেশগুলো যে প্রতিশ্রুত অর্থ দেয়ার কথা বলেছিল, তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

ব্রাজিলসহ অনেক দেশ বলছে, উন্নয়ন ব্যাংকগুলোকে সংস্কার করে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে, যাতে অভিযোজন প্রকল্পে অর্থপ্রবাহ বাড়ে। ব্রাজিল সরকার বিশেষ করে আমাজন বন রক্ষায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে চায়।

নতুন নির্গমন পরিকল্পনা ১০৬ দেশ জমা দিয়েছে :

জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুসারে, গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ১০৬টি দেশ নতুন বা হালনাগাদ জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) জমা দিয়েছে।

এগুলোতে নির্গমন হ্রাসের নতুন লক্ষ্য ও পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের অঙ্গীকার রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ এ সপ্তাহেই নতুন পরিকল্পনা জমা দিতে পারে বলে জানা গেছে। তবে জাতিসঙ্ঘের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে—এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলেও বিশ্ব উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমার নিচে রাখা সম্ভব নয়।

আগামী পথ আশা ও অনিশ্চয়তার দ্বন্দ্ব :

বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক বিভাজন ও জলবায়ু উদ্বেগের মধ্যে বেলেমের এই সম্মেলনকে অনেকে বলছেন— ‘আশা ও বাস্তবতার সংঘাতের কপ।’

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, অথচ দেশগুলো এখনো নিজেদের স্বার্থের ঘেরাটোপে।

প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই কপ কি নতুন কোনো কার্যকর চুক্তির জন্ম দেবে, নাকি প্রতিশ্রুতির ভিড়ে হারিয়ে যাবে বাস্তব পদক্ষেপ?

গতকাল সোমবার শুরু হওয়া কপ৩০ আগামী ২১ নভেম্বর শেষ হচ্ছে। এবারের সম্মেলনের মূল ইস্যু- জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগ, অর্থায়ন, কৃষি নির্গমন ও অভিযোজন।

আমাজন বনাঞ্চলের পাদদেশে বেলেম শহরের হ্যাঙ্গার কনভেনশন অ্যান্ড ফেয়ার সেন্টার অব দ্য অ্যামাজনের প্লেনারি অ্যামাজোনাস হলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন কপ২৯-এর সভাপতি এবং আজারবাইজানের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মুকতার বাবায়েভ, কপ ৩০-এর মনোনীত সভাপতি ব্রাজিলের সরকারি পরিবেশ, জলবায়ু নীতি ও স্থায়ী উন্নয়ন বিষয়ক নীতি প্রণয়নে জড়িত থাকা আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো এবং জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল।

এর আগে, মূল সম্মেলনের পূর্ববর্তী আলোচনার অংশ হিসেবে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের ‘বেলেম ক্লাইমেট সামিট’ অনুষ্ঠিত হয় ৬ ও ৭ নভেম্বর। দুই দিনের এ শীর্ষ সম্মেলনে বৈশ্বিক জলবায়ু পদক্ষেপ জোরদার এবং নির্গমন কমানোর বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হয়।

কপ৩০ সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ১৯০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন, যেখানে জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন নির্বাহী সচিব সিমন স্টিয়েল কপ৩০ সম্মেলনের আগের রাতে গতকাল রোববার (ব্রাজিলের স্থানীয় সময়) বলেন, প্যারিস (কপ২৬) চুক্তি ইতোমধ্যেই কার্যকর হচ্ছে, তবে আমাজনে জলবায়ু পদক্ষেপ আরো দ্রুত করা দরকার।

তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইতোমধ্যেই বড় ক্ষতি করছে- ক্যারিবিয়ানে হারিকেন মেলিসা, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনে সুপার টাইফুন, আর দক্ষিণ ব্রাজিলে টর্নেডো।’

স্টিয়েল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য উল্লেখ করেছেন যা কপ৩০-এ অবশ্যই অর্জন করতে হবে। সেগুলো হলো— সকল দেশের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করা যেমন- জলবায়ু সহযোগিতায় সবাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা যেমন: সব অর্থনীতির সব খাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া এবং মানুষের জীবনের সঙ্গে সংযোগ যেমন- জলবায়ু পদক্ষেপ যেন প্রত্যেকের জীবনে সুবিধা নিয়ে আসে – যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দূষণ কমানো, স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও নিরাপদ, সাশ্রয়ী শক্তি।

তিনি আরো বলেন, এটি তার চতুর্থ কপ, এবং প্রতিটি সম্মেলনে দেশগুলো পার্থক্য পার হয়ে সফল ফলাফল দিয়েছে।

বক্তব্যের শেষ বলেন, ‘চলুন কাজ শুরু করি।’

জানা যায়, ব্যয়, সময়সহ সামগ্রিক বিবেচনায় এ বছর বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই জলবায়ু সম্মেলনে ছোট সরকারি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। এবারই প্রথম মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যুক্ত হয়েছে। সব মিলে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি দলের সদস্য ১৫ জনের বেশি নয় বলে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণায়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

প্যারিস চুক্তির (২০১৫) পর এবারের কপ-৩০ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলন, যেখানে দেশগুলোকে ২০৩৫ সালের মধ্যে নির্গমন কমানোর নতুন পরিকল্পনা জমা দিতে হবে।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছেন, ‘বেলেম হবে সত্যিকারের কপ, যেখানে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব কাজের রূপরেখা তৈরি হবে।’

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা ও খরার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি খাত মারাত্মক ঝুঁকিতে। তাই জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি, খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ সম্মেলনে জোরালো প্রস্তাব তোলা হবে বলে জানা যায়।

কপ ৩০-এর মূল লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা; প্রতিটি দেশের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) বা জলবায়ু লক্ষ্য হালনাগাদ করা; জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন এবং ক্ষতি-ক্ষতির (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) তহবিল বাস্তবায়নে অগ্রগতি এবং ২০২৫ সাল পরবর্তী জলবায়ু চুক্তির রূপরেখা নির্ধারণ করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে কপ৩০-এ জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে জোরাল ভূমিকা রাখবে। জলবায়ু অভিযোজন, অর্থায়ন এবং ক্ষতি-ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মনে করে, উন্নয়নশীল ও জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য সময়োপযোগী ও অনুদানভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত না হলে বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।