যুক্তরাষ্ট্র অনেক বড় ইস্যুতে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত চাইছে

সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ডেনলুইচ

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুল্ক নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে দেরি হওয়া বা এখনো চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারাটা বাংলাদেশের ব্যর্থতা নয়।

কূটনৈতিক প্রতিবেদক
কথা বলছেন সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ডেনলুইচ
কথা বলছেন সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ডেনলুইচ |নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ও ঢাকায় দীর্ঘ দশ বছর কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকারী জন এফ ডেনলুইচ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুল্ক নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে দেরি হওয়া বা এখনো চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারাটা বাংলাদেশের ব্যর্থতা নয়। কেন না যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য এবং অনেক বড় ইস্যুতে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত চাইছে। সমঝোতায় পৌঁছাতে দুই পক্ষকেই এ ব্যাপারে একমত হতে হবে।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অনেক দেশই বাণিজ্য চুক্তি করতে চাচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) কার্যালয়সহ অন্যান্য সংস্থার সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই এক পক্ষের অবস্থান না বুঝে অন্য পক্ষকে সমালোচনা করা উচিত না। শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের তৃতীয় দফা সমঝোতা শিগগিরই শুরু হচ্ছে। তবে এটাই চূড়ান্ত সমঝোতা কি না তা আমার জানা নেই।

সোমবার রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এনএসইউ) আয়োজিত এক সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ডেনলুইচ এ সব কথা বলেন।

সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অব পলিসি এন্ড গভর্নেন্স (এসআইপিজি) এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন এনএসইউর ভিসি অধ্যাপক আব্দুল হান্নান চৌধুরী।

মার্কিন কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অগ্রাধিকার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ নিয়ে ঢাকার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। শুল্ক নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতা করছে তাকে আমি সাধুবাদ জানাই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শপথ নেয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সচেষ্ট ছিল। গত এপ্রিলে অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণার আগেই ট্রাম্প প্রশাসনের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পেরেছিল বাংলাদেশ। আর এজন্য অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণার পর বাংলাদেশ সঠিক পথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতা চালিয়ে যেতে পেরেছে।

তিনি বলেন, এটা সত্য যে- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব কমই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইউএসএইডের মাধ্যমে সহায়তা বন্ধ করে দেয়া শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য।

ডেনলুইচ বলেন, অনেকের ধারণা বাংলাদেশে ১/১১ ঘটানোর পেছনে (সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা) যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা ছিল বিপরীত। সেই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্র একটি ভালো ও নতুন যাত্রার আশা করেছিল। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার পতনের পেছনেও যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল বলে অনেকে ধারণা করছে। তবে এটা পতিত সরকারের একটি মিথ্যা অভিযোগ।

বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের অস্বস্থিকর সম্পর্ক ছিল উল্লেখ করে এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সুফিউর রহমান বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দিয়েছিল, যা আজো পুনর্বহাল হয়নি। এছাড়া মানবাধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, দুর্নীতি, একতরফা বা অনিয়মের নির্বাচন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রভৃতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ছিল, যা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছিল। চীনের সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও এর অরেকটি কারণ ছিল।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভারতের প্রভাব ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল। বাংলাদেশের একতরফা বা অনিয়মের নির্বাচনগুলোতে হস্তক্ষেপ না করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল ভারত। এ কারণে সর্বশেষ ২০২৪ সালে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র অহিংস নির্বাচনের অবস্থানে সরে এসেছিল। ‘ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর’ -এর কারণে বাংলাদেশ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় অগ্রাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রসর হতে পারছিল না। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়েছে- এমন একটা জোরালো ধারণা রয়েছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ক ভালো অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে সুফিউর রহমান বলেন, দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত সামরিক মহড়া চলছে। জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট এবং অ্যাকুজিশন এন্ড ক্রস সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট নামের দুটি চুক্তি বাংলাদেশের সাথে সই করার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তিগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। আর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধে চীন সরাসরি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাকে সমর্থন দিয়েছিল। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করেছে। বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক যাতে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশের উচিত একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।

এসআইপিজির পরিচালক অধ্যাপক তৌফিক হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ, এনএসইউর স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক এবং ডিন ড. একেএম ওয়ারেসুল করিম। স্বাগত বক্তব্য দেন এনএসইউর সহযোগী অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ সরকার।