মালয়েশিয়ার রাজধানী পুত্রজায়ায় মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে বিভিন্ন সমঝোতা স্মারকের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, শিগগিরই স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে বাংলাদেশী শ্রমিকরা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
এবারের আলোচনায় কর্মীদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে দুই দেশের সরকারপ্রধান একমত হয়েছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
মালয়েশিয়া সরকারের সাথে পুত্রজায়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ে দুই দফায় সভা হয়েছে। ওইসব সভা থেকে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে বিদ্যমান আইন ও বিধি মেনে মালয়েশিয়ায় কর্মী গমন করলেও উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের কারণে প্রক্রিয়াটি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্দিষ্ট সংখ্যক রিক্রুটিং অ্যাজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বিগত সরকার বিপুল সংখ্যক অ্যাজেন্সিকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার কারণে অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যায়। তবে কর্মীরা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর প্রায় সবাই কাজ পেয়েছে এবং তারা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছে। ফলে মালয়েশিয়া যাওয়া শ্রমিকদের কোনো অভিযোগ নেই।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় কর্মীদের ন্যূনতম বেতন ১ হাজার ৭০০ রিঙ্গিত। তাদের প্রাপ্ত বেতন-ভাতা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় মালয়েশিয়ায় যেতে বাংলাদেশী কর্মীদের আগ্রহ বেশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ ও ২০২২-২৪ মেয়াদে অনলাইনভিত্তিক ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক মালয়েশিয়া গেছেন। তাদের সবাই নিয়মিত কাজ ও বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। কর্মীদের কোনো অভিযোগ না থাকলেও কিছু অ্যাজেন্সির মালিক বৈধ ও আইনসঙ্গতভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো অ্যাজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে মামলা করেছে। তবে মালয়েশিয়া সরকার জানিয়েছে, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় নিয়মবহির্ভূত কোনো কার্যকলাপ হয়নি। দেশের অভ্যন্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা দীর্ঘ তদন্তের পর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে আদালতে রিপোর্ট দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে রিক্রুটিং অ্যাজেন্সি মালিকদের নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা, মামলা, নানা আন্দোলনের কারণে মালয়েশিয়া সরকার অনেকটা বিব্রত। তারা বাংলাদেশ থেকে নতুন করে কর্মী নিতে কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মঙ্গললবার দুই দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের এই বৈঠকটি আশার আলো জাগিয়েছে। এবারের আলোচনায় কর্মী এবং দেশের স্বার্থে শ্রমিকের সুরক্ষা ও নিরাপদ এবং স্বল্প ব্যয়ে লাভজনক কাজ নিয়োগের বিষয়ের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, যখনই দু’দেশের মধ্যে আলাপ আলোচনায় বাংলাদেশী কর্মীদের মালয়েশিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখনই দেশে জনশক্তি রফতানি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত কিছু অ্যাজেন্সি আন্দোলন, মানববন্ধন, গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে সম্ভাবনাময় অভিবাসন প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করে। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দু’দেশের সরকারপ্রধান অভিবাসন প্রক্রিয়াটিকে কর্মীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক অভিবাসন বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের বিষয়ে একমত হয়েছেন।
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলেন, সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া বাংলাদেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ১০ লাখেরও অধিক বাংলাদেশী কর্মী মালয়েশিয়ায় কর্মরত আছেন। বেতন-ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা সব মিলিয়ে এসকল কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় ভালো আছেন। এরপরও দেশের অভ্যন্তরের কিছু অ্যাজেন্সি প্রতিযোগী দেশ ও তাদের স্বার্থে কাজ করা ব্যক্তিরা দেশ ও কর্মীদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করে চলেছে।
তারা আরো বলেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষাসহ শ্রমিকদের কল্যাণ প্রসঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ও গঠনমূলকভাবে আলাপ-আলোচনা চলছে। ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল আলোচনাটি বাংলাদেশী শ্রমিকদের শোষণ এবং নির্যাতনের মাধ্যম হিসেবে রয়ে যেতে পারে মর্মে রিপোর্ট করছে।
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী জানান, কথিত অভিবাসী কর্মীদের বিষয়ে অভিজ্ঞ বলে পরিচিত অ্যান্ডি হাল এবং বাংলাদেশের অভিবাসন বিষয়ক গবেষক রহমান নামক ব্যক্তি বাংলাদেশী কর্মীদের দাসত্বের শৃঙ্খল চলমান থাকার ইঙ্গিত দিয়ে মারাত্মক ধরনের নেতিবাচক রিপোর্ট করেছেন। প্রকৃত সত্য হলো যে, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে কর্মরত এক মিলিয়ন কর্মীর সাথে সম্পৃক্ত দেশে এক মিলিয়ন পরিবার সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। এক মিলিয়ন বেকার কর্মীর কর্মসংস্থান থেকে বছরে গড়ে তিন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসছে। এটি একটা চলমান প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে দেখা গেছে, পুরাতন কর্মী দেশে আসছেন, নতুন কর্মীরা মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। সমালোচনাকারীরা এই বিপুল সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থানের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা বা অসচ্ছল পরিবারগুলোর জন্য কখনোই কর্মংস্থান করতে সমর্থ হবেন না। তাই সমালোচনা অবসান ঘটিয়ে এই শীর্ষ বৈঠকে নতুন কর্মীদের সম্মানজনক ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। নতুন করে বিপুল সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে মালয়েশিয়ায়। এছাড়া ইতোমধ্যে ভিসাপ্রাপ্ত প্রায় আট হাজার কর্মী, যারা নির্ধারিত সময়ে মালেয়েশিয়ায় গমন করতে পারেননি তাদের নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আগামী ছয় বছরে মালয়েশিয়ায় কমপক্ষে ১২ লাখ বা তারও বেশি শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, দু’দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আলাপ আলোচনার পর কেটে যাবে সকল জটিলতা। শিগগিরিই বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য আবার খুলে যাবে মালয়েশিয়ার বাজার। তাই এ মুহূর্তে সরকার শ্রমিকদের স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে নিরাপদ কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে।