পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায়, আলোচনায় যেসব ইস্যু

তার এই সফরে বাণিজ্য, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কী আলোচনা হবে এ নিয়ে যেমন হিসাবনিকাশ চলছে, তেমনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটিও সামনে আসছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
শনিবার দুপুরে বাংলাদেশে পৌঁছান পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার
শনিবার দুপুরে বাংলাদেশে পৌঁছান পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার |সংগৃহীত

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার বাংলাদেশ সফরে এসে অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সাথেও বৈঠক করছেন। এক যুগেরও বেশি সময় পর তিন দিনের ব্যবধানে পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দু’জন প্রতিনিধির বাংলাদেশ সফর নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

তার এই সফরে বাণিজ্য, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কী আলোচনা হবে এ নিয়ে যেমন হিসাবনিকাশ চলছে, তেমনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটিও সামনে আসছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সাথেই বা কী আলাপ হচ্ছে তা নিয়েও রয়েছে কৌতূহল।

শনিবার দুপুরে ইসহাক দার ঢাকা পৌঁছানোর পর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও এনসিপির প্রতিনিধিরা তার সাথে বৈঠক করে।

বৈঠকের পর বিএনপি দিক থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে রোববার সন্ধ্যায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে ইসহাক দার দেখা করবেন বলে জানিয়েছে বিএনপির মিডিয়া সেল।

বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে সেগুলো অনুকূল পরিবেশে দ্রুত শেষ করা দরকার।

আর এনসিপি সাংবাদিকদের জানিয়েছে, বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ১৯৭১ সালের ইস্যুকে ডিল করা উচিত।

এদিকে ইসহাক দার ঢাকায় আসার আগেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুই দেশের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, এই সফরের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিকসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হবে।

তবে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়াসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে যেসব দাবি উঠেছে সেসব বিষয়ে এবার কোনো আলোচনা হবে কি না সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে শনিবার একাধিকবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ল্যান্ডমার্ক ভিজিট বা ঐতিহাসিক সফর হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে তার দেখা করার পাশাপাশি দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় কতগুলো বিষয়ে চুক্তি সইয়েরও কথা রয়েছে।

পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পর দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের এসব বৈঠক ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

তারা বলছেন, কেবল পাকিস্তান নয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সব দেশের সাথেই সম্পর্ক ভালো সম্পর্ক রাখাটা জরুরি।

তবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চালানো গণহত্যার বিষয়ে পাকিস্তান কী অবস্থান নেয় সেটিও বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যত ঠিক করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করেন সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অনেকে।

তারা বলছেন, বাণিজ্য, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়, যেমন- একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ে যাওয়া সম্পদের হিস্যার মতো বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

অমীমাংসিত বিষয়ে আলোচনা জরুরি

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাকিস্তানের সাথে খুব একটা সু-সম্পর্ক দেখা যায়নি বাংলাদেশের। দেশটির সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সফর কিংবা লেনদেনও ছিল সীমিত।

সবশেষ ২০১২ সালে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন হিনা রব্বানি খার।

তবে গত বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে দেখা গেছে। দুই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সফরের পর এবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরাও রাষ্ট্রীয় সফর করছেন।

শনিবার পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দারের ঢাকা সফরের আগে গত বুধবার বাংলাদেশে আসেন দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান। তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনসহ ব্যবসায়ী নেতাদের সাথেও কথা বলেন।

ইসহাক দার তার সফরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাথে বৈঠক করবেন।

এসব বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ছয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। যেখানে দুই দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ, বাণিজ্য বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের মতো বিষয়গুলো রয়েছে।

দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের এই আলোচনায় সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এই পর্যায়ের সফর সাধারণত রাজনৈতিক গতি আনে সম্পর্কে, সেই দিক থেকে তার এই সফরটা গুরুত্বর্পূর্ণ। ফরেন মিনিস্ট্রি পর্যায়ের সফর যখন হয় সেখানে বিভিন্ন সেক্টরের সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়।’

তবে এসব আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা স্বাধীনতাপূর্ব অভিন্ন সম্পদের জন্য বকেয়া অর্থ দাবির’ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হবে কিনা ঘুরেফিরে আসছে এই আলোচনাও।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু পাকিস্তান নয় সব দেশের সাথেই সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। তবে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের যে দাবিদাওয়াগুলো রয়েছে সেগুলোও বিবেচনায় রাখা জরুরি।

কবির বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘একাত্তর সালে এখানে গণহত্যার দায়, পাকিস্তানিদের এই দায়টা স্বীকার করতে হবে এবং সেটার জন্য আকারে ইঙ্গিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে তারা বলেছে। কিন্তু আমরা চায় যে তারা এই দায়িত্বটা নিয়ে প্রকাশ্যে এর একটা সমাধান করুক।’

অবশ্য গত ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য ক্ষমা কিংবা স্বাধীনতাপূর্ব অভিন্ন সম্পদের জন্য বকেয়া অর্থ দাবির’ মতো বিষয় ফলাও করে প্রচার করা হয়।

এছাড়া স্বাধীনতাপূর্ব ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে চার দশমিক তিন দুই বিলিয়ন বা ৪৩২ কোটি ডলার চেয়েছে বলেও তখন জানানো হয়েছিল।

যদিও পাকিস্তানের দিক থেকে দেয়া বক্তব্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর কোনো উল্লেখ ছিল না।

একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইলে কোনো সরকার পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের খুব একটা অগ্রগতি করতে পারবে বলে মনে করেন না সাবেক রাষ্ট্রদূত রাশেদ আহমেদ চৌধুরীও।

তিনি বলছেন, ‘ট্রেড, ইকোনমিক রিলেশনশিপ, পিপল টু পিপল কনটাক্ট এগুলো তো অবশ্যই এগোতে হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, পাকিস্তানের সাথে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহা করা গেলে এই সফরটা ফলপ্রসূ হবে।’

রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও আলোচনা

শনিবার পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকা আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার সাথে বৈঠক করেন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।

তার সাথে বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি'র সাত সদস্যের প্রতিনিধি দল।

বৈঠক শেষে দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের যেকোনো ধরনের সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবশ্যই একাত্তরের ইস্যুকে ডিল করা উচিত। আমরা সে বিষয় উত্থাপন করেছি।’

এছাড়া সার্ক ইস্যুতেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে বলে জানান এনসিপি'র মূখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘ভারতের কারণে সার্ক ইনঅ্যাক্টিভ হয়ে আছে, পাকিস্তানের সাথে এ বিষয়ে কথা হয়েছে।’

এরপর ইসহাক দারের সাথে দেখা করতে ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসে যান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল।

বৈঠক শেষে দলটির নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং কিভাবে সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি করা যায়, এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

‘সকল প্রতিবেশী দেশের সাথেই আমাদের সুসম্পর্ক থাকা দরকরা,’ বলেন তাহের।

একাত্তরের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না– সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি দুটি সরকারের আলোচনার বিষয়, আমরা আশা করি, সরকার সেগুলো আলোচনা করবে।’