সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির নানামুখী প্রচেষ্টা

দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে সমাজে অস্থিরতা চলতে থাকে : ড. মাসুম

দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় কমবেশি খুন, হত্যা ধর্ষণ, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।

মনিরুল ইসলাম রোহান
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নড়াইলে পুড়িয়ে দেয়া একটি ঘর
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নড়াইলে পুড়িয়ে দেয়া একটি ঘর |নয়া দিগন্ত

দেশে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পাশাপাশি অসন্তোষ ও অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করেছে। একের পর এক খুন, হত্যা, ধর্ষণ, মারামারি হানাহানি সংঘর্ষসহ একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক আচরণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঠুনকো বিষয় নিয়ে সমাজের মানুষ দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এর রেশ ছড়িয়ে পড়ছে বসতবাড়ি এবং নারী ও শিশুদের ওপর। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বসতবাড়ি, সর্বস্ব লুটপাট করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বসতঘর কিংবা দোকানপাট। এ যেন ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসন্ত্রাসের মহোৎসব চলছে। সামাজিক এই অস্থিরতার পেছনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তৃণমূল রাজনৈতিক ইন্ধন কাজ করছে। প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়ে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সমাজের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষও অসহায় হয়ে ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছেন বলে স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঘটনা-১ : ১৯ এপ্রিল সিঙ্গাড়া খাওয়ার সময় হাসাহাসিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বনানীর প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজ নির্মমভাবে খুন হন তার সহপাঠীদের হাতে। ঘটনার আগে বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উভয়পক্ষের মধ্যে মীমাংসাও করে দিয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি পারভেজের। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

ঘটনা-২ : ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাউজানে গাজীপাড়া গ্রামের বাজারের একটি দোকানের সামনে মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে গুলি করে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। এর আগে ১৯ এপ্রিল দিবাগত রাত দেড়টার দিকে একই উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গরিব উল্লাহপাড়া গ্রামের ভাণ্ডারি কলোনির একটি বাসায় ভাত খাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা মোহাম্মদ মানিক আবদুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে। তারা দু’জনই যুবদলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

ঘটনা-৩ : ১১ এপ্রিল এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার ১ নম্বর বাবরা-হাচলা ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামে উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি শিহাব উদ্দিন মিলন মোল্যা ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান আত্তাব গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হন। তাদের মধ্যে আহত একজন ছিলেন আত্তাব গ্রুপের ফরিদ মোল্যা। ঘটনার কমপক্ষে চার ঘণ্টা পর হাসপাতালে বিনাচিকিৎসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন- এলাকাবাসীর এমন অভিযোগ রয়েছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ওইদিন রাতে আত্তাব গ্রুপের লোকজন প্রতিপক্ষের অন্তত ৫০টি বাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর করে এবং মালামাল, স্বর্ণালঙ্কারসহ আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায়। অন্তত ২০টি বাড়িতে পুলিশের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই রাতের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই প্রতিপক্ষের কোনো না কোনো বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাটের মহোৎসব চলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। পুরুষ শূন্য এলাকা এখন বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে। এলাকার নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই এলাকায় এখন ইরি ধান কাটার মৌসুম চলছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গত ১৫ দিন তারা ঘরবাড়ি ছাড়া। মাঠভর্তি পাকা ধান কাটতে দেয়া হচ্ছে না। মাইকিং করে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যে ধান কাটতে গেলে তাদের দেখে নেয়া হবে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও হুমকি দেয়া হচ্ছে। কারো কারো ধান জোর করে তারা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় এক বিএনপি নেতার ছত্রছায়ায় আত্তাব গ্রুপের লোকজন প্রতিদিনই ছিনতাই, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে ওই এলাকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। পুরুষশূন্য গ্রামে এলাকার ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা সবকিছু হারিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনযাপন করছেন।

ঘটনা-৪ : জুলাই আন্দোলনে শহীদ হন পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জসীম উদ্দিন। স্বামীহারা হয়ে স্ত্রী পরিবারের হাল ধরার চেষ্টা করছিলেন। পথে গেল ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় শহিদ জসীম উদ্দিনের মেয়ে তার বাবার কবর জিয়ারত শেষে নানাবাড়ি পাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে যাচ্ছিলেন। পথে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন শহীদ জসিমের মেয়ে লামিয়া। এমনকি তার নগ্ন ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয় ধর্ষক সিফাত, সাকিব ও জলিলরা। পারিপার্শ্বিক নানা চাপ সইতে না পেরে এইচএসসি পড়ুয়া মেয়েটি গেল শনিবার রাতে রাজধানীর আদাবরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর আগেও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নোয়াখালীর একলাশপুরে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতাকর্মী। ওই নির্যাতনের রেশ কাটতে না কাটতেই জেলার চাটখিলে বসতঘরে ঢুকে জোরপূর্বক চাচীকে ধর্ষণ করে এবং ভিডিও ধারণ করে প্রতিবেশী ভাসুরের ছেলে শরীফ বাহিনীর প্রধান ও ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি মজিবুর রহমান শরীফ ও তার লোকজন।

উল্লিখিত ঘটনাগুলোই কেবল নয়, তথ্য বলছে, দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় কমবেশি এসব খুন, হত্যা ধর্ষণ, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। কোনো কোনোটি গণমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসছে বলে তোলপাড় সৃষ্টি হচ্ছে, অপরাধীকে ধরার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এমন অনেক ঘটনা ঘটছে যা কোনো গণমাধ্যমেও আসছে না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তোলপাড় হচ্ছে নাÑ ফলে অপরাধ কর্মকাণ্ড এবং অপরাধীরা আড়ালে থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক ঘটনা তোলপাড় সৃষ্টি হলেও সময়ের পরিক্রমায় অথবা আর্থিক প্রভাব বা সামাজিক প্রভাবে ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাষ্ট্র চিন্তক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন হলেও গত ৮ মাসে আশাতীত কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছি না। তবে আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক দিক তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, একটি সমাজে স্থিতিশীলতা নির্ভর করে ওই দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। এখন যারা ক্ষমতায় আছে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করে না। যার ফলে অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশের যেসব বড় দলগুলো সহায়তা করার কথা তারা সেটা করছে না। তারা আছে নতুন নতুন চাঁদাবাজির ক্ষেত্র তৈরি নিয়ে। ড. মাসুম মনে করেন, সমাজে খারাপ কাজের শাস্তির সম্ভাবনা যদি কম থাকে, যদি অপরাধীরা বুঝতে পারে দোষটা ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে রক্ষা পাওয়া যাবে তাহলে সেই সমাজে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়, এ জন্য সমাজে একটি অস্থিরতা বিরাজ করে। এখন ঠিক সে রকম একটি সময় আমরা পার করছি। রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলগুলো মনে করছে সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব নাই, কোনো দায়-দায়িত্বও নাই।