গ্রিসে উচ্চ বেতনের চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণামূলকভাবে লিবিয়ায় পাচার, শারীরিক নির্যাতন এবং দেশে বসে মুক্তিপণ আদায়— এমনই এক মানব পাচার চক্রের সক্রিয় এক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির মানব পাচার ইউনিট (টিএইচবি)।
গ্রেফতার ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ নজির হোসেন (৫৫)। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার থানার ইধনপুর গ্রামের মোজাফ্ফর আলীর ছেলে।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে সিআইডি। তার বিরুদ্ধে সিআইডিতে তদন্তাধীন দু’টি পৃথক মামলা রয়েছে বলেও এলে জানানো হয়।
সিআইডি জানিয়েছে, গত ৪ ডিসেম্বর চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানায় রুজু হওয়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে করা মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, চক্রটির গ্রিস প্রবাসী অন্যতম সদস্য মো: শরীফ উদ্দিন (৩৬) ২০২৪ সালে দেশে এসে বাদি ও অন্য এক ভুক্তভোগী যুবককে গ্রিসে লোভনীয় বেতনের চাকরি দেয়ার প্রস্তাব দেন। এজন্য জনপ্রতি ১৫ লাখ টাকা চুক্তি হলে প্রাথমিকভাবে বাদি ও অন্য এক যুবক প্রত্যেকে পাসপোর্ট ও দুই লাখ টাকা করে শরীফ উদ্দিনকে দেন। চলতি বছরের জুলাই মাসে শরীফ উদ্দিন ওই দু’জনকে বিমানযোগে বাংলাদেশ থেকে দুবাই, সেখান থেকে মিসর হয়ে লিবিয়ায় পাঠান।
লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর চক্রের মনোনীত ব্যক্তি তাদের গ্রহণ করে এবং পরে একদল মাফিয়ার হাতে তাদেরকে তুলে দেয়। সেখানে তাদের কাছ থেকে ডলার ও ইউরো ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং আটক রেখে শারীরিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি মুক্তিপণ দাবি করা হয়। দেশে বসে চক্রের হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী গ্রেফতারকৃত মোহাম্মদ নজির হোসেন (৫৫) ও অন্যান্য সহযোগীরা দুই ভুক্তভোগী পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করেন। তারা বিভিন্ন সময় ও তারিখে এক ভুক্তভোগী যুবকের পরিবারের কাছ থেকে মোট ২১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং অন্য যুবকের পরিবারের কাছ থেকে মোট ১৬ লাখ টাকা আদায় করে।
মুক্তিপণের টাকা নেয়ার পরও ভুক্তভোগীদের মুক্তি না দিয়ে লিবিয়ার পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। ৪৫ দিন জেল হাজতে কাটানোর পর গত ২৯ আগস্ট বাদি ও অন্য যুবকটি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসামিদের কাছে টাকা চাইলে তারা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখায়।
গ্রেফতারকৃত নজির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ ভিকটিমদের প্রলুদ্ধ করে ইউরোপ নেয়ার কথা বলে লিবিয়ায় পাঠিয়ে আসছে। উচ্চ বেতনের চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মোট ১৯ জনের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে চক্রটির বিরুদ্ধে। যার মধ্যে নয়জন ভিকটিম আইওএমের সহায়তা দেশে ফেরত আসতে পেরেছেন। বাকিরা এখনো লিবিয়ার বিভিন্ন মাফিয়ার কাছে আটক আছেন।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ডিএমপি’র ডেমরা মডেল থানায় রুজু হওয়া অপর এক মামলায়ও গ্রেফতারকৃত নজির হোসেনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে সিআইডি। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, চক্রটির অন্যতম সদস্য এজাহারনামীয় এক নম্বর অভিযুক্ত মো: বাহাদুর ফারাজীর সাথে ভুক্তভোগীর মোবাইলে পরিচয় হয়। বাদিকে গ্রিসে লোভনীয় বেতনের চাকরি দেয়ার প্রস্তাব দিলে বাদি রাজি হয়ে ফারাজীকে পাসপোর্ট ও নগদ আট লাখ টাকা দেন।
মামলাটি তদন্তকালে জানা যায়, চলতি বছরের জুলাই মাসে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এজাহারনামীয় দুই নম্বর অভিযুক্ত গ্রেফতারকৃত নজির ভুক্তভোগী বাদিকে পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকেট সরবরাহ করেন। পরে বাদি দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছালে চক্রের অন্য এক সদস্য তাকে গ্রহণ করে এবং তাকে লিবিয়ার বেনগাজির একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা দাবি করে। পূর্বের উল্লেখিত ঘটনার ন্যায় গ্রেফতারকৃত নজির ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে মোট ১১ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। মুক্তিপণ পেয়ে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সহযোগীরা ভিকটিমকে মরুভূমিতে ছেড়ে দেয়। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। লিবিয়ায় মোট ১৯ দিন কারাবন্দী থাকার পর এই ভুক্তভোগী আইওএমের সহায়তায় গত ২৫ আগস্ট দেশে ফিরতে সক্ষম হন।
দেশে ফিরে এই ব্যাপারে ডিএমপির ডেমরা মডেল থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। এই মামলায় ইতোপূর্বে চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
তদন্তে পাওয়া যায়, উপরোল্লিখিত দু’টি মামলা ছাড়াও গ্রেফতারকৃত মোহাম্মদ নজির হোসেন ডিএমপির বিমানবন্দর থানার অপর একটি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।
তদন্ত চলমান দু’টি মামলারই কার্যক্রম বর্তমানে সিআইডির মানব পাচার ইউনিট (টিএইচবি) পরিচালনা করছে। নজির হোসেন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দু’টি মামলাতেই নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। তাকে আদালতে সোপর্দকরণ ও রিমান্ডের আবেদনসহ পরবর্তী আইনগত কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।



