লাশের ২৬ টুকরো

ব্ল্যাকমেইল করে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা থেকে হত্যা : র‌্যাব

জরেজ হাতুড়ি দিয়ে আশরাফুলকে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকেন। এসময় শামীমা তাকে বলতে থাকেন কেন তিনি আশরাফুলকে মারছেন এবং তিনি বাধা দেন। এতে জরেজ তাকেও মারধর করতে থাকেন। এক পর্যায়ে অতিরিক্ত আঘাত এবং মুখ কসটেপ দিয়ে আটকানো থাকায় শ্বাস না নিতে পারায় ঘটনাস্থলেই আশরাফুল মারা যান।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
জরেজ বাজার থেকে চাপাতি ও দু’টি ড্রাম এনে আশরাফুলের লাশ ২৬ টুকরো করে ড্রামে ভরে
জরেজ বাজার থেকে চাপাতি ও দু’টি ড্রাম এনে আশরাফুলের লাশ ২৬ টুকরো করে ড্রামে ভরে |ইন্টারনেট

রাজধানীর শনিরআখড়া এলাকায় রংপুরের ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্ল্যাকমেইল করে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। তবে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড পূর্বের কোনো ক্ষোভ ছাড়া সম্ভব না বলেও জানায় র‌্যাব।

আজ শনিবার সকালে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন। মামলার প্রধান আসামি জরেজুল ইসলামের প্রেমিকা শামিমা আক্তার কোহিনুরের (৩৩) স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে তিনি এ তথ্য জানান।

এর আগে, শুক্রবার সকালে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার বড় বিজরা এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে শামিমাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, ব্ল্যাকমেইলিং এবং লাশ গুমের পুরো সহযোগিতায় জড়িত ছিলেন।

এদিকে, এ ঘটনায় প্রধান আসামি জরেজকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ডিবি’র সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে বলে পুলিশে সূত্রে জানা গেছ।

র‌্যাব জানিয়েছে, গত ১১ নভেম্বর রাতে রংপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন ব্যবসায়ী আশরাফুল হক। তিনি একই এলাকার বন্ধু জরেজুল ইসলামের সাথে ব্যবসায়িক পাওনা আদায়ের জন্য ঢাকায় আসেন। ১২ নভেম্বর সকাল থেকে তার পরিবার তার মোবাইল বন্ধ পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।

১৩ নভেম্বর হাইকোর্ট এলাকার পানির পাম্প সংলগ্ন দু’টি নীল রঙের ড্রাম থেকে ২৬ টুকরো করা এক অজ্ঞাতপরিচয়ের ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। পরে আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণে লাশের পরিচয় নিশ্চিত হয়।

গ্রেফতার শামীমা আক্তারের মোবাইল বিশ্লেষণ ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি ও জরেজুল এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন। জরেজুল তাকে জানান, তার এক বন্ধুকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে ১০ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব। এর মধ্যে সাত লাখ নেবে জরেজুল আর তিন লাখ পাবে শামীমা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার এক মাস আগে থেকেই শামীমা নিহত আশরাফুলের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে তাকে আকৃষ্ট করেন। নিয়মিত অডিও-ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

ফায়েজুল আরেফীন বলেন, গত ১১ নভেম্বর রাত ৮টায় জরেজ ভিকটিম আশরাফুলকে নিয়ে ঢাকায় রওনা হন। ঢাকায় আসার পর গত ১২ নভেম্বর জরেজ ও আশরাফুল শামীমার সাথে দেখা করে ঢাকার শনির আখড়ার নূরপুর এলাকায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটি বাসা ভাড়া করে তিনজন একত্রে ভাড়া বাসায় ওঠেন।

এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, রংপুর থেকে ঢাকায় আসার আগে জরেজ তার প্রেমিকা শামীমা আক্তারকে ফোনে জানান যে আশরাফুলের সাথে সে যেন অন্তরঙ্গ ভিডিও ধারণ করে এবং সেই ভিডিও দেখিয়ে যাতে ১০ লাখ টাকা আদায় করা যায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভুক্তভোগী আশরাফুলকে মালটার শরবতের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হালকা অচেতন করেন শামীমা। যাতে বাইরে থেকে জরেজ অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করলে আশরাফুল তা বুঝতে না পারে। পরে যখন তারা একান্ত সময় কাটায়, তখন জরেজ বাইরে থেকে ভিডিও ধারণ করেন। ওই ভিডিও শামীমার মোবাইলে ধারণ করা হয়, যা বর্তমানে উদ্ধারকৃত মোবাইলে রয়েছে।

শামীমার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ১২ নভেম্বর দুপুরে আশরাফুল পুরোপুরি অচেতন হয়ে পড়লে জরেজ তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং মুখে কসটেপ লাগায়। এরপর ইয়াবা সেবনের উত্তেজনায় জরেজ হাতুড়ি দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকেন। এসময় শামীমা তাকে বলতে থাকেন কেন তিনি আশরাফুলকে মারছেন এবং তিনি বাধা দেন। এতে জরেজ তাকেও মারধর করতে থাকেন। এক পর্যায়ে অতিরিক্ত আঘাত এবং মুখ কসটেপ দিয়ে আটকানো থাকায় শ্বাস না নিতে পারায় ঘটনাস্থলেই আশরাফুল মারা যান।

র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক জানান, পরদিন সকালে জরেজ বাজার থেকে চাপাতি ও দু’টি ড্রাম এনে লাশ ২৬ টুকরো করে ড্রামে ভরে। দুপুরে একটি সিএনজি ভাড়া করে ড্রামগুলো বাসা থেকে বের করে, পরে মাঝপথে সিএনজি পরিবর্তন করে হাইকোর্টের মাজার গেটের কাছে পৌঁছায়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দেখে তারা ড্রাম দু’টি সড়কের পাশের গাছতলায় ফেলে দ্রুত অটোযোগে সায়েদাবাদে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে জরেজ শামীমাকে কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে চলে যেতে বলে। এরপর থেকে দু’জনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

শামীমার তথ্য অনুযায়ী, শনিরআখড়ার নূরপুর এলাকা থেকে আশরাফুলের রক্তমাখা পাঞ্জাবি-পায়জামা, হত্যায় ব্যবহৃত দড়ি, কসটেপ, একটি গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট উদ্ধার করেছে র‌্যাব-৩।

র‌্যাব জানিয়েছে, তাদের মূল উদ্দেশ্য ব্ল্যাকমেইল করে ১০ লাখ টাকা আদায় করার পরিকল্পনা থাকলেও এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড পূর্বের কোনো ক্ষোভ ছাড়া সম্ভব না। তবে এ বিষয়ে তারা নিহতের বন্ধু জরেজের সাথে এখনো কথা বলতে পারেনি। ফলে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।

শামীমা জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের পর মালয়েশিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল জরেজের। এজন্য পাসপোর্টও তৈরি করতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই শামীমা ও জারেজ গ্রেফতার হন।

গ্রেফতার শামীমা আক্তারকে আইনি প্রক্রিয়ার জন্য শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হবে বলেও জানিয়েছে র‌্যাব।