ঢাকার টঙ্গী এলাকায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ইতালিতে পাচারকালে তোয়ালের ভেতর বিশেষ কায়দায় দ্রবীভূত করা প্রায় সাড়ে ৬ কেজি ভয়ঙ্কর মাদক ‘কিটামিন’ জব্দ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ কর্মকর্তা) মোস্তাক আহমেদ এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান।
গ্রেফতাররা হলেন মো: মাসুদুর রহমান জিলানী (২৮) ও মো: আরিফুর রহমান খোকা (২৮)।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডিএনসির গোয়েন্দা বিভাগ দীর্ঘদিন যাবত কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে মাদক পাচারের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি করে আসছে এবং এই গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতায় বিভিন্ন সময় বেশ কিছু চালান জব্দ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে, ডিএনসির কাছে গোপন তথ্য ছিল যে একটি চক্র আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে দেশের বাইরে মাদক পাচার করছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা শাখার একটি বিশেষ টিম টঙ্গীতে ফেডেক্স কুরিয়ার সার্ভিসে অবস্থান নেয় এবং ফেডেক্সের সার্বিক সহযোগিতায় ঢাকা হতে ইতালিগামী একটি পার্শ্বেল জব্দ করে। গোয়েন্দা তথ্য, পার্সেলের সার্বিক অবস্থা ও অস্বাভাবিক ওজন দেখে সন্দেহ হলে পার্সেলটি পরীক্ষা করে একটি খাকি রঙের কার্টুনের ভেতর পৃথক সাতটি সাদা তোয়ালে পাওয়া যায়। ঘটনাস্থলেই ডিএনসির রাসায়নিক পরীক্ষক দিয়ে তোয়ালেগুলোর পরীক্ষা করলে সেগুলোর ভেতর দ্রবীভূত অবস্থায় ৬.৪৪ কেজি ‘ক’ শ্রেণির ভয়াবহ মাদক কিটামিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
মোস্তাক আহমেদ বিজ্ঞপ্তিতের আরো জানান, পরবর্তীতে ডিএনসির একটি বিশেষ রেইডিং টিম জব্দকৃত পার্সেলের প্রেরকের ঠিকানা, সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্যান্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে যে প্রেরক গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে আত্মগোপন করেছেন। এর ভিত্তিতে ঢাকা গোয়েন্দা ইউনিট একটি অভিযান পরিচালনা করে চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর এলাকা থেকে প্রেরক মো: মাসুদুর রহমান জিলানীকে (২৮) গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে আরো তথ্য পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা যায়, ওই ‘কিটামিন’ চালান ফরিদপুর জেলার মো: আরিফুর রহমান খোকার (৪৩) সাথে যোগসাজশে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছিল এবং আরো জানা যায় যে খোকা এই আন্তর্জাতিক চক্রের অন্যতম হোতা।
এরপর তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রেইডিং টিম ফরিদপুর জেলার সালথা থানাধীন আটঘর বাজার এলাকায় আর একটি অভিযান পরিচালনা করে মো: আরিফুর রহমান খোকাকে গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে দু’টি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন এবং একটি বাটন মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনিও কুরিয়ারের মাধ্যমে কিটামিন পাচারের সাথে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন।
মানবদেহে কিটামিনের ক্ষতিকর প্রভাব
কিটামিন (Ketamine) মূলত একটি ডিসোসিয়েটিভ অ্যানেস্থেটিক ওষুধ, যা অতীতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অপারেশনের সময় অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে এটি ব্যাপকভাবে মাদক হিসেবে অপব্যবহার করা হচ্ছে, বিশেষ করে পার্টি ড্রাগ হিসেবে। কিটামিন একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর মাদক, যা স্বল্পমেয়াদে বিভ্রান্তি, হ্যালুসিনেশন ও শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কিডনি ও মূত্রথলির গুরুতর ক্ষতি, মানসিক সমস্যা এবং আসক্তির দিকে ঠেলে দেয়। নিয়মিত সেবনে সহনশীলতা তৈরি হয়ে ডোজ বাড়ানোর প্রবণতা দেখা দেয়, যা জীবনের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করে।
তোয়ালেতে যেভাবে লুকানো হয়
তোয়ালে বা মোটা কাপড় ব্যবহার করে মাদক পাচার একটি গোপন কৌশল, যেখানে তোয়ালের ভেতরে গঠন পরিবর্তন করে মাদক লুকানো হয়। কেমিক্যাল ইমপ্রেগনেশনে তোয়ালেকে মাদকের দ্রবণে ভিজিয়ে শুকানো হয়, ফলে মাদক ফাইবারে মিশে যায়। কাপড় বা তোয়ালেটি মাদক শোষণ করলে সেটি দেখতে স্বাভাবিক কাপড়ের মতোই মনে হয়, ফলে এটি সহজে শনাক্ত করা যায় না। পাচারকারীরা পরে বিশেষ কেমিক্যাল বা ল্যাব প্রসেস ব্যবহার করে ওই কাপড় থেকে পুনরায় মাদক উত্তোলন করে। এই পদ্ধতি কোকেন, হেরোইন ও কেটামিন পাচারে বেশি ব্যবহৃত হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের নতুন নতুন কৌশল প্রতিরোধে কুরিয়ার সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে সমন্বয় করে নিয়মিত নজরদারি ও অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, গ্রেফতার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরো একাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। গ্রেফতার দুই আসামির বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে নিয়মিত মামলা রুজু করা হয়েছে।