এক হাজার ৭৭টি মোমবাতি প্রজ্জ্বলনসহ নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৭৭তম জন্মদিন তার পরিবার এবং ভক্তরা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পালন করেছে। দিবসটি উপলক্ষে গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী গ্রামে হুমায়ূন আহমেদের হাতে গড়া নুহাশপল্লীতে নানা আয়োজন করা হয়।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সকাল থেকেই হুমায়ূন আহমেদের ভক্তরা কবরে শ্রদ্ধা জানাতে নুহাশপল্লীতে ভিড় জমায়।
নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক মো: সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ১মিনিটে গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী গ্রামে হুমায়ূন আহমেদের হাতে গড়া নুহাশপল্লীতে এক হাজার ৭৭টি মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেন নুহাশপল্লীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ভোর রাতে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে নুহাশপল্লীতে আসেন। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি দু’ ছেলেকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের কবরে পুষ্পপস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। তারা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ, কবর জিয়ারত ও মোনাজাত করেন। এদিকে প্রতিবারের মতো এবারেও সকাল হতে হুমায়ূন পরিবার, তার ভক্ত, কবি, লেখক আর নাট্যজনেরা ফুল হাতে শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন নুহাশপল্লীর লিচু তলায়। নন্দিত লেখকের প্রিয় চরিত্র হলুদ পাঞ্জাবিতে হিমু এবং নীল শাড়িতে রূপা সেজে আসেন ভক্ত ও পাঠকেরা। তারা লেখকের প্রতি অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা জানান।
মরহুম লেখকের কবর জিয়ারত শেষে নুহাশপল্লীতে হোয়াইট হাউসের পাশে স্থাপিত হুমায়ূন আহমেদের ম্যূরালের সামনে আপেল গাছ তলায় দু’ ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে হুমায়ুন আহমেদের ৭৭তম জন্মদিনের কেক কাটেন মেহের আফরোজ শাওন। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের জন্মদিন উপলক্ষে এ সময় শতাধিক হুমায়ূনভক্ত, গণমাধ্যমকর্মী ও নুহাশপল্লীর কর্মচারীরাসহ এলাকার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। তাদের অনেকের হাতে ফুল ছিল প্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে।
কবর জিয়ারত শেষে মেহের আফরোজ শাওন গণমাধ্যমকে হুমায়ূনের স্বপ্ন পূরণের ব্যর্থতা তুলে ধরেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের ক্যান্সার হাসপাতাল ও জাদুঘর বিনির্মাণে ব্যর্থতার দায় নিজের ওপর চাপিয়ে নিয়ে জোড় হাত করে সকলের কাছে ক্ষমা চান। তিনি হুমায়ূনের স্বপ্ন ক্যান্সার হাসপাতাল ও যাদুঘর নির্মাণের নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, আপনাদের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের পাঠক, ভক্ত ও দর্শকদের কাছে আমি জোড় হাত করে ক্ষমা চাইছি। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় অনেক কিছু করার বা স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে। আমি সেগুলো করার চেষ্টা করেছি। কিন্ত্র আমি অতিক্ষুদ্র একজন একা মানুষ। আমার ওপর আমার পরিবার, সন্তান ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আছে। আমি আপনাদের কাছে বা আপনাদের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের জাদুঘর, ক্যান্সার হাসপাতাল বা অন্যান্য স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করার কথা বলেছি, আমি সবগুলোই চেষ্টা করেছি বিভিন্নভাবে। আসলে ব্যাপারটা হলো এগুলো করতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় যে টাকা তুললাম আর করে ফেললাম। সবকিছুই করতে হয় অনেক নিয়মতান্ত্রিকভাবে। এ ক্ষেত্রে আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমি খুবই হতাশার সাথে বলছি আমি স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমি স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে আমি কোনো টাকা বা আর্থিক সহায়তা চাইনি। আমি চেয়েছিলাম মেন্টাল সাপোর্ট দিয়ে গুছিয়ে বাস্তবায়ন করার জন্য বুদ্ধিজীবী এবং দেশের নীতিনির্ধারকরা আমার পাশে থাকবেন। এজন্য যখন যে সরকার ছিলেন, সেসব সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমি বহুবার গিয়েছি, কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমি দুঃখিত। তারা যদি আমার পাশে থাকতেন তাহলে এতদিনে হুমায়ূনের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো।
শাওন বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ একজন অসম্ভব স্বপ্নবান মানুষ ছিলেন। তার কাছে থেকে আমি কখনো হতাশ হতে শিখিনি। তাই আমি এখনো হুমায়ূন আহমেদের জন্য সবটুকু না হোক অল্প কিছু স্বপ্ন হলেও পূরণ করতে চাই।’
এদিকে সকাল থেকেই হুমায়ুন আহমেদের ভক্তদের সংগঠন ‘হিমু পরিবহন’র সদস্যদের গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে ভিড় জমাতে দেখা গেছে। তারা কথাসাহিত্যিক ও লেখক হুমায়ূন আহমেদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং ঘুরে ঘুরে নুহাশপল্লী দেখেন। দিবসটি উপলক্ষে নুহাশপল্লীতে এদিন প্রবেশ ফি ফ্রি করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নবেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে তাকে সমাহিত করা হয়।
তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করেন। ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে ডিস্টিংশন নিয়ে অনার্সসহ এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। সেখানে মাত্র ছয় মাস থাকার পরই তিনি চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ একাধারে ছিলেন শিক্ষক, সমাজসেবী, গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, চিত্রকর, চিত্রনাট্য লেখক, নাট্যনির্দেশক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রবন্ধকার ইত্যাদি। সাহিত্যের সব জায়গায় ছিল তার সরব উপস্থিতি। কখনো আবার রং-তুলির ছোঁয়ায় রাঙিয়েছেন ক্যানভাসের রংহীন সাদা স্থান। পিছিয়ে ছিলেন না নির্মাণেও। ছোট পর্দা, বড় পর্দায় তার নানা সৃষ্টি বাঙালির মনে দাগ কেটে থাকবে হাজার বছর। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর গবেষণা করে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। সেসময় থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা তিন শতাধিক।



