টেকসই হচ্ছে না নদী ও সাগরের প্রতিরক্ষা বাঁধ, হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

‘সাগর উপকূলে নির্মাণাধীন অবকাঠামোতে লবণ পানি প্রবেশ করে পরে তা শুকিয়ে গিয়ে স্থাপনায় ফাটল বা ক্ষয় হয়ে বিনষ্ট হয়।’

এস এম রহমান, পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম)

Location :

Chattogram
উপকূল প্রতিরক্ষা বাঁধ
উপকূল প্রতিরক্ষা বাঁধ |নয়া দিগন্ত

লবণ ও আর্দ্রতা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কোনোভাবেই টেকসই হচ্ছে না দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ দেশে নদীর তীর ও সাগর উপকূল রক্ষায় প্রতিরক্ষা বাঁধ। এতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের ডিজাইন বা নকশা মোতাবেক প্রতিরক্ষা কাজ সম্পন্ন করা হলেও কয়েক বছরের মধ্যে বাঁধের সিসি ব্লকে লবণ ও জলীয়বাস্প প্রবেশ করে বিনষ্ট হয়ে বা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে দ্রুততম সময়ে বিলিন হয়ে পড়ছে এসব প্রতিরক্ষা কাজ।

বর্তমানে নদী ও খালের তীর ও সাগর উপকূলে নির্মাণাধীন প্রতিরক্ষামূলক বেড়িবাঁধের স্থায়ীত্ব ৫০ বছরের অধিক ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ডিজাইন বা নকশা অনুযায়ী দরপত্রের শর্তানুসারে সিমেন্ট বালুসহ নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে নিয়োজিত ঠিকাদাররা বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ করলেও তার স্থায়ীত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে যা এখনও কাটেনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে আদ্রতা ও লবণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে সাগর উপকূলে, নদীর তীর বা খালের প্রতিরক্ষামূলক কাজের নির্মিত ব্লক বিনষ্ট হওয়া নিয়ে ২০১৮ সালে জুলাই মাসে নয়া দিগন্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতামতসহকারে সচিত্র একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরেও বিগত প্রায় ৭ বছরেও লবণ ও আদ্রতা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

প্রতিরক্ষা কাজে লবণ ও আর্দ্রতা প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নেয়ায় ২০১০ সালে বাঁশখালী উপকূলের খানখানাবাদের কদম রসুল এলাকায় নির্মিত বেড়িবাঁধ সাগরের লোনাপানিতে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে বিলিন হয়ে পড়ায় এখন নতুন প্রতিরক্ষা কাজ চলছে। অপর দিকে ২০১৪-১৫ সালে আনোয়ারা উকূলের নির্মিত প্রতিরক্ষা বাধঁ বিনষ্ট হয়ে পড়েছে যা উপকূলে গেলেই চোখে পড়ে। তা ছাড়া ২০১৬ সালে বাঁশখালী উপজেলায় ২৯৩ কোটি ও আনোয়ারা উপজেলায় প্রায় পৌনে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাগর উপকূল ও নদীর তীর ভাঙন প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা বাঁধ নিমার্ণ কাজ শেষ হয়। এরই মধ্যে বাঁশখালীর কয়েক কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজের সিসি ব্লকগুলো ক্ষয় হওয়া শুরু করেছে।

বর্তমান সময়ে সরকার সাগর উপকূল ও নদীর ভাঙন প্রতিরোধে টেকসই প্রতিরক্ষামূলক বাঁধ নিমার্ণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে,অথচ এসব নির্মাণ কাজে লবণ ও আর্দ্রতা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধের স্থায়ীত্ব নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

জানা গেছে, সাগর বা নদী উপকূলে ভাঙন প্রতিরোধে প্রতিরক্ষামূলক টেকসই প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজে-সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। আর এই বাঁধ নির্মাণে অর্ডিনারী র্পোটল্যান্ড সিমেন্ট (ওপিসি) ও পোর্ট ল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট ( পিসিসি) ব্যবহার করা হচ্ছে।

জলবায়ুর পরিবর্তনবিষয়ক আই পি সি সি’র এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তেনের প্রভাবে বিশ্বেব্যাপী উষ্ণায়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আবহাওয়ার উপাদানগুলোর পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রক্রিয়ায় বিশ্বের যে কয়টি দেশের পরিবেশ বিপর্যয়সহ মানুষের জীবনজীবিকা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় ইতোমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশে জলবায়ুর প্রভাবে এখন পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এর প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে মাটি ও পানিতে লবণাক্ততাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সেন্টার ফর এনভায়রন্টমেন্ট আ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল সাভির্সের (সিইজিআইএস) এক গবেষণায় জানা গেছে, প্রতি বছর দেশের তিনটি উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রেপৃষ্ঠের উচ্চতা ছয় থেকে ২০ মিলিমিটার করে বাড়ছে। গত ৩০ বছরের তথ্য নিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপন্নতা শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, বছরে চট্টগ্রাম সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে ১১-২০ মিলিমিটার, গঙ্গা অববাহিকায় সাত থেকে আট মিলিমিটার এবং মেঘনা অববাহিকায় ছয় থেকে নয় মিলিমিটার উচ্চতা বাড়ছে।

ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)’র গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ২১০০ সালের মধ্যে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে ৩০০ থেকে ৭১০ মিলিমিটার, যা বৈশ্বিক পরিস্থিতির তুলনায় বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় অঞ্চলের উচ্চতা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। জলোবায়ুর পরিবর্তন ধরণ পাল্টে যাওয়ায় বিশ্বের ভিন্নি দেশে লবণ ও আর্দ্রতা প্রতিরোধে টেকসই কংক্রিট অবকাঠামো স্থাপন বা নির্মাণে প্রচলিত সিমেন্টের সাথে আ্যাড মিকচার (ট্রাইক্যালশিয়াম সালফেট, ট্রাই ক্যালশিয়াম এলামিনেন্ট, ক্যালশিয়াম সিলিকেট হাইড্রেড জেল (সিএসএইচ) ব্যবহার করা হয় অবকাঠামো নির্মাণে এসব ক্যামিক্যাল মেশানোর ফলে স্থাপন বা তৈরি করা অবকাঠামোতে সহজে সাগরের লবণাক্ত পানি ও আর্দ্রতা কোনো ক্ষতি করতে পারে না তবে তাও স্থায়ী নয়।

ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি কংক্রিট স্থাপনা নির্মাণে ইতোমধ্যে লবণ ও আর্দ্রতা প্রতিরোধে সক্ষম পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট স্ল্যাগ সিমেন্ট (পিএসসি) ব্যবহার করছে। তাছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট(পিসিসি) এবং অর্ডিনারী পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট(ওপিসি) ব্যবহার করা হলেও তাতে আ্যাড মিক্সার ব্যবহার করা বাধ্যতা মুলক করা হলেও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের উপকূল ও নদীর সুরক্ষায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই প্রতিরক্ষামুলক বাঁধ নির্মাণে বা তৈরীতে ব্যবহার করছে অর্ডিনারী পোর্টল্যান্ড(ওপিসি) সিমেন্ট, এছাড়াও সিসি ব্লক তৈরীতে নির্মাণ সামগ্রীর মিশ্রন রেশিও করা হয়েছে ১-৩-৬(এক বস্তা সিমেন্ট তিন বস্তা বালু ছয় বস্তা পাথরের টুকরো) পরবর্ততিতে মিশ্রণ রেশিওতে পরিবর্তন করে বর্তমানে রেশিও ১-২-৪ করা হলেও এখনও লবণ ও আদ্রতা প্রতিরোধের ক্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এসব কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত প্রতিরক্ষা বাঁধ সাগরের লোনাপানিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিমার্ণের কয়েক বছরের মধ্যে বিনষ্ট হয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি একটি সেমিনারে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরো: প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকুল ইসলাম সাদী বলেন, সমুদ্রে লবণে থাকা ক্লোরাইড আয়রনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় কংক্রিট নির্মিত স্থাপনার ইস্পাতে সহজেই মরিচা ধরে, কংক্রিটের ভিতর অতিমাত্রায় লবণ ও আদ্রতা জমে গিয়ে ইস্পাতে মরিচা পড়ে এর ফলে খুব দ্রুততম সময়ে পুরো কাঠামোতে ক্ষয় ও ফাটল দেখা দেয় একারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্থাপনাগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।

বর্তমানে পানি উন্নয়ন ৫০ বছরের অধিক টেকসই সক্ষম করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে অর্ডিনারী পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট ব্যবহার করছেন। কোথাও কোথাও আ্যাড মিক্সার মেশানো হয়না (যদিও অ্যাডমিক্সার স্থায়ী ব্যবস্থা নয়)

সাগরে টেকসই সিসি ব্লক দিয়ে প্রতিরক্ষা বাধঁ বা কংক্রিট স্থাপনা খুব অল্প সময়ের মধে ক্ষয়ে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরো: প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী ড.এমডি মঈনুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, সাগর উপকূলে নির্মাণাধীন অবকাঠামোতে লবণ পানি প্রবেশ করে পরে তা শুকিয়ে গিয়ে স্থাপনায় ফাটল বা ক্ষয় হয়ে বিনষ্ট হয়।

তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে পাওয়া পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট (পিসিসি) কিছুটা ভাল হলেও অর্ডিনারী পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট(ওপিসি) কোনোভাবেই দীর্ঘদিন টেকসই হতে পারেনা তার কারণ এসব সিমেন্টে লবণ বা আদ্রতা প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই।

তিনি আরো বলেন, উপকূলী অঞ্চলে ব্যবহারের জন্য এখন পোর্টল্যান্ড স্ল্যাগ সিমেন্ট (পিএসসি) পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি সিমেন্ট কোম্পানি এই সিমেন্ট এখন বাজারজাত করছে। তিনি বলেন, কোনোভাবেই অর্ডিনারী পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট বা পোর্টলান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট দিয়ে টেকসই স্থাপনা দীর্ঘস্থায়ী করার কল্পনা করা যায় না।

গতকাল বিকেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা নকশা ও গবেষণা) মো: জহিরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও ব্যস্ততার কারণে তিনি মোবাইল রিসিভ না করায় তার মতামত নেয়া যায়নি।