পর্যটকদের কাছে অপার বিস্ময় নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট। সবুজ চা বাগান, পাহাড় টিলা আর হাওর বেষ্টিত এই অঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবারের দুর্গাপূজার টানা ছুটিতে সিলেট অঞ্চলে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। ৫-৭ লাখ পর্যটক সিলেট ঘুরেছেন উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার মিলে এই সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের বিশেষ ব্যবস্থার কারণে এবার পর্যটন স্পটগুলোতে কোনো ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনার খবর মিলেনি। কোথায় বাড়তি ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে সিলেটে ঘুরতে আসা পর্যটকদের মুখে ছিল তৃপ্তির হাসি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছুটির শুরুতে মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) থেকেই সিলেটে পর্যটকের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। পুণ্যভূমি সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সিলেটে ছুটে আসতে থাকেন নানান বয়সী ভ্রমণ পিপাসুরা। ফলে পর্যটক সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে সিলেটের হোটেল মোটেল কর্তৃপক্ষকে।
শুক্রবার (৩ অক্টোবর) সিলেটে সবচেয়ে বেশী পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। নগরীর অভিজাত থেকে শুরু করে মধ্যম এমনকি সাধারণ মানের হোটেল গুলোতে রুম খালি না থাকায় হাজার হাজার পর্যটককে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। পর্যটন স্পটের পাশাপাশি শহরের চা বাগানগুলোতেও হাজার হাজার পর্যটকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
পর্যটক সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের দুর্গাপূজায় দীর্ঘ সরকারি ছুটি থাকায় প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পর্যটক এসেছেন পর্যটন নগরী সিলেটে। বিলাসবহুল হোটেল মোটেলগুলো শতভাগ বুকিং ছিল। এছাড়া মধ্য মানের ও অল্প ভাড়ার হোটেলও খালি ছিল না। অনেক পর্যটক অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে রাত্রিযাপন করেছেন।
শারদীয় দুর্গাপূজার ছুটিতে পর্যটন নগরী সিলেটে ঢল নামছে পর্যটকদের। নামিদামি হোটেলগুলোতে অন্তত ১৫দিন আগেই বুকিং শতভাগ সম্পন্ন হয়ে যায়। এতে করে যারা হোটেল বুকিং করে আসেননি, তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। সিলেট নগরীর জিন্দাবাজার, দরগা গেইট, আম্বরখানা, বন্দরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার হোটেল ঘুরে এই সংকট দেখা গেছে।
এদিকে, পর্যটকদের ঢল নামায় কৃত্রিমভাবে কক্ষ সঙ্কট তৈরি করেছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা। এই সুযোগে এক হাজার টাকা ভাড়ার কক্ষ দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত চাইছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা। এতে বিপাকে পড়ছেন সিলেটে ঘুরতে আসা পর্যটকরা।
তবে কিছু হোটেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে- আগে পর্যটক টানতে হোটেল গুলোতে ভাড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেয়া হতো। এবার পর্যটক বেশী থাকায় ছাড় দেয়া হয়নি। এতে অনেকেই ধরে নিয়েছেন বেশি ভাড়া আদায় হয়েছে। তবে বাস্তবে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশী নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সিলেটের হোটেল ব্যবসায়ী ও পর্যটন-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৫ দিন আগে থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে সিলেটের হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলো বুকিং দিয়ে রেখেছেন পর্যটকরা। ভালোমানের হোটেলগুলো প্রায় শতভাগই বুকিং হয়ে গেছে আগেভাগে। বিশেষত বড় হোটেল ও রিসোর্টগুলোর কোনো কক্ষই ফাঁকা নেই।
অন্যদিকে সিলেটে জাতীয় ক্রিকেট লীগ (এনসিএল) চলমান থাকায় খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের জন্য নগরীর বিভিন্ন হোটেলে প্রায় ২০০টি কক্ষ আগামী ১২ অক্টোবর পর্যন্ত বুকিং রয়েছে। যার ফলে পর্যটকদের জন্য হোটেল সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সিলেটে কয়েক শতাধিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই পর্যটকনির্ভর। এখানকার প্রধানতম পর্যটন কেন্দ্র জাফলং, সাদাপাথর, রাতারগুল ও বিছনাকান্দি।
জানা গেছে, পর্যটকদের কাছে বরাবরই রোমাঞ্চকর বাংলাদেশের একমাত্র জলের বন রাতারগুল। বনের ভেতর নৌকা ভ্রমণের সময় নানা প্রজাতির সাপ ও প্রাণী রোমাঞ্চিত করে পর্যটকদের। সেখানকার বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলরবও মনোমুগ্ধকর। কোম্পানিগঞ্জের সাদা পাথরও অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। নদীর পরিস্কার ধবধবে পানি আর সাদা পাথরে মন ছুঁয়ে যায় পর্যটকদের। অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির জাফলং ও বিছানাকান্দিও পর্যটকদের বিমোহিত করে। এসব পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাখো মানুষ আসেন সিলেটে। এছাড়া হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরাণ (র.) মাজার এবং চা বাগানের সবুজ দৃশ্য মন কাড়ে পর্যটকদের।
পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এবারের পূজায় দীর্ঘ ছুটি থাকায় রেকর্ড পরিমাণ পর্যটক সিলেটে এসেছেন। সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলো মিলিয়ে ১০ লাখেরও বেশি পর্যটক বেড়াতে এসেছেন। ফলে এসব অঞ্চলের কোনো হোটেল মোটেলই খালি ছিল না। পর্যটকে ভরপুর ছিল সিলেট ও শ্রীমঙ্গলের হোটেল মোটেলগুলো।
জানা গেছে, পূজার ছুটির শুরু থেকেই সিলেটের সাদাপাথর, জাফলং, রাতারগুল ও বিছানাকান্দিতে পর্যটকদের বিপুল সমাগম ঘটে। এখনও ছুটি থাকায় প্রতিদিনই পর্যটকদের আনাগোনা লেগে আছে এসব পর্যটন স্পটে। শতভাগ রুম আগে থেকেই বুকিং ছিল। আর যারা হোটেল আগাম বুকিং না দিয়ে এসেছিলেন, তাদেরকে সস্তা মানের হোটেলেও রুম পেতে হিমশিত খেতে হয়েছে।
জিন্দাবাজারস্থ হোটেল গোল্ডেন সিটির জেনারেল ম্যানেজার মিষ্টু দত্ত দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘অনেক দিন পর সিলেটের হোটেল ব্যবসায়ীরা পর্যটক কেন্দ্রিক ভালো ব্যবসা করতে পেরেছেন। তবে অগ্রিম বুকিং দিয়ে শেষ পর্যন্ত না আসায় কিছু হোটেল কর্তৃপক্ষকে কিছুটা হলেও লোকসান গুণতে হয়েছে। পরিচিত থাকায় চাইলে ভাড়া আদায় করা সম্ভব হয়নি।
নগরীর আম্বরখানা এলাকার হোটেল গ্র্যান্ড শাহ কামালের ম্যানেজার (অপারেশন্স) নোমান আহমদ দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানান, ‘এবারের পূজার দীর্ঘ ছুটিতে সিলেটে পর্যটকের ঢল নেমেছিল। গত ২ দিনে রুম খালি না থাকায় শুধু আমরাই অন্তত ২ হাজার পর্যটককে ফিরিয়ে দিয়েছি।’
সিলেটের হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘এবার পূজার লম্বা ছুটিতে সিলেটের হোটেল-মোটেলে মোটামুটি ভালো ব্যবসা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পর্যটন ব্যবস্থাপনা খুব ভালো ছিলো। তবে সিলেটের হাইওয়ের রাস্তা খারাপ হওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষকে একদিন পর্যন্ত ছাড় দিতে হয়েছে। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পর্যটকদের ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরী হয়েছে। আগাম বুকিং থাকায় তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও সুযোগ ছিলনা। এই লোকসানটা হোটেল মালিকদের বহন করতে হয়েছে।’
এ ব্যাপারে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যে সমন্বয় করে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি পর্যটন স্পটগুলোতে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন ছিল এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্পট পর্যবেক্ষণ করা হয়। সব মিলিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তায় পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়েছে।’
এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: সারওয়ার আলম জানান, ‘সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোতে জেলা প্রশাসনের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছিল। ফলে বেশি সংখ্যক পর্যটকের উপস্থিতি সত্বেও কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেনি।’