জুলাই-আগস্টের গণহত্যার এক বছর পার হলেও এখনো শোক কাটেনি ভোলার শহীদ পরিবারগুলোতে। থামেনি কান্নার শব্দ। প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি আজো ভুলতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা।
ভোলার চরফ্যাশন ও সদর উপজেলায় গিয়ে কথা হয় কয়েকজন শহীদ পরিবারের সাথে। অবুঝ শিশুরা এখনো রয়েছে বাবার অপেক্ষায়। কিন্তু তারা জানে না বাবা আর কোনো দিনই ফিরবেন না।
চরফ্যাশন উপজেলার নুরাবাদ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চর তোফাজ্জল গ্রামের মিলন ফরাজী বাড়ির শহীদ ওমর ফারুকের মা ইয়ানুর বেগম আজো শোকে কাতর। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদছেন প্রতিনিয়ত।
ইয়ানুর বেগম জানান, তার তিন সন্তানের মধ্যে শহীদ ওমর ফারুক দ্বিতীয়। অভাবের কারণে বড় দুই সন্তানকে পড়াশুনা করাতে পারেননি। প্রায় ৫ বছর আগে অভাব দূর করতে স্বপরিবারে ঢাকায় যান। ওমর ফারুক একটি দোকানে কর্মচারীর কাজ নেয়। তার বাবা মিলন ফরাজী ঢাকায় দারোয়ানের চাকরি করতেন। তিনি বাসা বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। আর বড় ছেলে নাঈম মিষ্টির দোকানের কর্মচারী ও ছোট ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো। সবাই মোহাম্মদপুরে থাকতেন। সবাই মিলে কাজ করায় মোটামুটি ভালোই চলছিল তাদের সংসার।
তিনি জানান, ২০২৪ সালের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সাথে অংশ নেয় ১৬ বছরের কিশোর ওমর ফারুক। দোকান মালিকের বাড়িতেই থাকত ওমর ফারুক। কিন্তু ৪ আগস্ট সকালে তিনি নাস্তা করে দোকানে না গিয়ে মায়ের কাছে ফিরে আসে। জিজ্ঞাসা করলে জানায়, আজ আর দোকানে যাবেন না। ছেলে দুপুরে বাসায় খাবেন, তাই বাজার করতে যান। বাজার করে বাসার কাছাকাছি এলেই স্থানীয়রা তাকে জানান, ওমর ফারুক আন্দোলনে গিয়ে মোহাম্মদপুরের ওভার সেতু এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
পরে তিনি বড় ছেলেসহ স্থানীয়দের সাথে ছেলেকে খুঁজতে বের হন। সরওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গুলিবিদ্ধ ছেলের লাশ দেখতে পান। তখন থেকেই তার কান্না শুরু, আজো থামেনি। আজো ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদেন সন্তান হারা মা ইয়ানুর বেগম।
সদর উপজেলার পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের গুপ্তমুন্সি গ্রামের হাওলাদার বাড়ির শহীদ শামীম হাওলাদারের মা বিউটি বেগমেরও কান্না থামেনি।
তিনি জানান, শামীম ঢাকায় বিদ্যুতের কাজ করতেন। প্রতিদিনই মায়ের সাথে কথা হতো তার। ঘটনার দিন ২০ জুলাই দুপুরে কথা হয়। তখনো সুস্থ ছিলেন শামীম হওলাদার। কিন্তু সন্ধ্যার একটু আগে ফোন আসে শামীম গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাকে কেউ স্পষ্ট না বললেও তিনি বুঝতে পারেন ছেলে আর নেই।
শহীদ শামীম হওলাদারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম আসমা জানান, তাদের ছোট ছোট তিন সন্তান। বড় ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে, মেজো ছেলে শিশু শ্রেণিতে ও ছোট ছেলের বয়স মাত্র ৪ বছর। ২০ জুলাই দুপুরের দিকে কথা হয় তার সাথে। ছোট ছেলের সাথেও কথা হয় শামীমের। ওই দিন শামীম আন্দোলনে গেলে দুপুরের দিকে রাবার বুলেট লাগে শরীরে। ওই কথা শুনে তিনি আর আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য বলেন। ওই সময় তার ছোট ছেলেও বাবাকে অনুরোধ করে আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য। এটাই ছিল তাদের সাথে শামীম হাওলাদারের শেষ কথা। পরে সন্ধ্যার দিকে জানতে পারেন বিকেলে শামীম মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। পরে তার লাশ ঢাকা থেকে এনে গ্রামের বাড়িতে দাফন করেন।
সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের শাহমাদার গ্রামের শহীদ মো: হাসানের বাবা মো: মনির হোসেন জানান, ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে শহীদ হন তার ছেলে হাসান। পরিবারের অভাবের কারণে কয়েক বছর আগে ঢাকার কাপ্তান বাজার এলাকায় এরশাদ মার্কেটে দুলাভাইয়ের ইলেকট্রনিক্স দোকানে কর্মচারীর চাকরি নেন তিনি। অসুস্থ মা-বাবা ও ছোট দুই ভাই-বোনের লেখাপড়ার দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। থাকতেন যাত্রাবাড়ীতে বোনের বাড়িতে।
৫ আগস্ট হাসান শহীদ হলেও তার লাশ তখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে তারা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও মর্গে খোঁজ করেন। অবশেষে জানুয়ারি মাসের দিকে ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে থাকা কয়েকটি অজ্ঞাত লাশের মধ্যে প্রাথমিকভাবে হাসানকে শনাক্ত করে তার পরিবার। পরে ডিএনএ পরীক্ষায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি হাসানের পরিচয় শনাক্ত হয়।
তিনি জানান, হাসান শহীদ হওয়ার এক বছর পার হলেও এখন শহীদ হাসানের নাম সরকারিভাবে গেজেটভুক্ত হয়নি। তার পরিবার সরকারি কোনো সহযোগিতাও পায়নি। ফলে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের।
তবে ভোলা জেলা প্রশাসক মো: আজাদ জাহান জানান, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ হওয়া ভোলার এ পর্যন্ত ৪৭ জন শহীদের নাম গেজেটভুক্ত হয়েছে। শহীদ হাসানের নাম অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গেজেটভুক্ত হবে বলে আশা করছি। এছাড়া আরো কিছু শহীদের পরিবার আবেদন করেছে। আমরা যাচাই-বাছাই করে গেজেটভুক্ত করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব।
তিনি আরো জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কয়েকবার আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে শহীদ পরিবারকে। কয়েক দিনের মধ্যে দুই লাখ টাকা করে শহীদ পরিবারকে দেয়া হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভোলার সমন্বয়ক মো: রাহিম ইসলাম জানান, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানী ঢাকা, ভোলা ও মাদারীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ভোলার অর্ধশতাধিক বাসিন্দা শহীদ হন। এদের মধ্যে সরকারিভাবে গেজেটভুক্ত হয়েছেন ৪৭ জন। বাকিদেরও দ্রুত সরকারিভাবে গেজেটভুক্ত করার দাবি করেন তিনি। এছাড়া তিনি শহীদ ও আহত পরিবারের জন্য সরকারিভাবে সব ধরনের সহযোগিতারও দাবি জানান।