আন্ধারমানিক নদী। নামের মাধ্যমে যেন মন ছুঁয়ে যায়। কিন্তু সেই আন্ধারমানিক এখন মৃত্যু প্রায়। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার প্রধান নদী। এ এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় এ নদী ‘মানিক’ ছড়িয়েছে। নিজের শরীর নিংড়ে উৎপাদন করছে কৃষকরা সোনালি ফসল। বুকে আগলে রাখছে রুপালি ইলিশ।
পৌর শহরের গুরুত্বপূর্ণ আন্দারমানিক নদী দখল ও বর্জ্যের চাপে বিপর্যস্ত। কলাপাড়া প্রধান নদী আন্দারমানিক পাড়জুড়ে প্লাস্টিক আর পলিথিন বর্জ্যের স্তূপ। প্রতিনিয়ত সেগুলো গিয়ে মিশছে নদীর পানিতে। এতে বিনষ্ট হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বহমান নদীর এমন পরিণতির জন্য তীরবর্তী ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন অনেকে। আবার সঙ্কট কাটাতে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ পরিবেশ অধিদফতরের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তথ্য মতে, আন্ধারমানিক নদীর পানি প্রবাহের দৈর্ঘ্য ৩৯ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৩৩০ মিটার। এই নদীর গভীরতা ১৫ মিটার। এখন প্রতি বছর অন্তত পাঁচ ফুট কমে যাচ্ছে নদীর প্রস্থ। নদীটির দু’পাড়ে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে।
ইলিশ প্রজনন সময় বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নদীতে পলির আস্তরণ বাড়বে। আন্ধারমানিক নদ ইলিশের অভয়াশ্রম। এই নদের সাথে অনেক জেলের জীবন-জীবিকা জড়িত। পানির প্রবাহ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ইলিশ বিচরণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একই নদীর আট কিলোমিটারে পরপর তিনটি সেতু নির্মাণে নদের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে পলির আস্তরণ জমে ইতিমধ্যে কমেছে নদের প্রস্থতা। অনেক জায়গায় জেগে উঠেছে ছোট-বড় চর। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় ৪৫০ প্রজাতির মাছ এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ অভয়াশ্রম।
অন্যদিকে জীবিকা নিয়ে ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছে প্রায় এক হাজার জেলে পরিবার। আন্ধারমানিক নদে দশ কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি সেতু নির্মাণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে এর পানি প্রবাহ, জমছে পলির আস্তরণ। ধ্বংসের মুখে পড়েছে ইলিশসহ ৪৫০ জীববৈচিত্র্যের বিশাল অভয়াশ্রম। ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভার নিবন্ধন করা জেলের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩০৫ জন ও রাঙ্গাবালী উপজেলার ১৩ হাজার ৮৪৭ জন নিবন্ধিত জেলে।
ইলিশের অভায়শ্রম আন্ধারমানিক নদী ভালো নেই। জোয়ারেও থাকে না স্রোতের ধারা। পলির আস্তারণে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। দু’পাড় সংকুচিত হয়ে গেছে। দখল করা হয়েছে দু’তীরের প্লাবন ভূমি। করা হয়েছে বাড়ি-ঘর, পুকুর, মাছের ঘের। করা হয়েছে দশের অধিক ইটভাটা। দূষণ চলছে সমানতালে। কলাপাড়া পৌরশহরের অধিকাংশ বর্জ্য যাচ্ছে নদীতে। মোহনায় নিজামপুরে জেগেছে ডুবোচর। এক কথায় ঐতিহ্যবাহী এককালের স্রোতস্বিনী এই নদীটি এখন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। সাগর মোহনা থেকে উজানে উঠে আসা এ নদীটি মিলেছে রাবনাবাদ চ্যানেলে।
৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্ধারমানিক নদীর সাথে সংযুক্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা নদী মেরে ফেলার কারণে এ নদীর অবস্থা ক্রমশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি প্রবীণ ব্যক্তিত্ব আইয়ুব আলী হাওলাদার ভাষ্যমতে, ৮০ দশকের প্রথমদিকে আন্ধারমানিকের সাথে সংযুক্ত কচুপাত্রা নদীতে বাঁধ দেয়ায় পানির প্রবাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এ নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ হওয়ার প্রথম ও অন্যতম একটি কারণ কচুপাত্রার বাঁধ। এর পরে আরেক শাখা নদী আরপাঙ্গাশিয়া প্রাকৃতিকভাবে ভরাট হয়ে দুই-তৃতীয়াংশ চাষের জমিতে পরিণত হয়েছে। এ দু’শাখা নদী দিয়ে অন্তত ৩০ কিলোমিটার দূরে জোয়ারের পানি বরগুনার পায়রা নদীতে পর্যন্ত গড়াতো। একইভাবে নদীর সাথে স্লুইস সংযুক্ত অসংখ্য খালে জোয়ারের পানি প্রবেশের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে।
এতে পানির প্রবাহ ভয়াবহভাবে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সৃষ্ট ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে সাগর মোহনায় নিজামপুরে বিরাট ডুবোচর জেগে ওঠে। পানির প্রবাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে দ্রুত পলির আস্তরণে নদীর তলদেশ ভরাট হতে থাকে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, ছোট ট্রলার পর্যন্ত ভাটিতে চলাচলে সমস্যা হয়। এক সময় স্টিমার, দোতলা-একতলা লঞ্চ চলাচল করা নদীটা এখন সংকটাপন্ন অবস্থায় পতিত হয়েছে। যদিও রাবনাবাদ চ্যানেল থেকে পৌরশহর লঞ্চঘাট পর্যন্ত এখন দোতলা লঞ্চ চলাচল করতে পারছে। তাও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। আটকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকছে।
৮০’র দশকের পরে এই নদীর তীরের দু’পাড়ের শত একর প্লাবন ভূমিকে কাগজ পত্রে চাষযোগ্য কৃষি জমি দেখিয়ে কথিত ভূমিহীনকে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। এই চক্র কাগজ পত্রে নদী তীরের মালিকানা পেয়ে চুপচাপ থাকে। এরা দশ-বিশ বছর পরে ওই জমি দখল করে পুকুর, মাছের ঘের থেকে শুরু করে বাড়ি ঘর করেছে। আবার কেউ কেউ লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে হস্তান্তর করে দিয়েছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণের পাশাপাশি মানুষের দখলদারিত্ব নদীটিকে অস্তিত্ব সঙ্কটের ফেলে দেয়। এছাড়া এ নদীতে আট কিলোমিটারের মধ্যে দু’টি সেতু করা হয়েছে। আরো একটি সেতুর কাজ চলমান রয়েছে। নদীকে মেরে ফেলার এটিও একটি অন্যতম কারণ।
কলাপাড়া পৌরসভা এলাকায় পুরোনো ফেরিঘাট থেকে বালিয়াতলী খেয়াঘাট পর্যন্ত নদীতীরসহ প্লাবন ভূমিতে ইটভাটা সহ অসংখ্য স্থাপনা তোলা হয়েছে। এই দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। পৌরশহরের পুরান বাজার স্লুইস খাল থেকে প্রতিদিন মণকে মণ পলিথিন, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য আন্ধারমানিক নদীতে যাচ্ছে। পৌরবাসীর পারিবারিক বর্জ্য সব ভেতরের খাল থেকে নদীতে যায়। কাঁচা বাজার এলাকায় নদীতীরে পানির লেভেল বরাবর নিত্যকার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। নদীটিকে যেন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিকভাবে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনজনিত কারণে এ নদীটি পলির আস্তরণে ভরাট হয়ে গেছে। এখন দু’তীরের ভাঁটার সময় জেগে ওঠা চর এলাকায় চলছে দখলের খেলা। এভাবে দখলদারিত্ব চলতে থাকলে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীটি অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এখন শুধু নামেই ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদী।
পৌর শহরের উল্টোদিকে শেখ কামাল সেতুর পূর্বদিকে সলিমপুরে আন্ধারমানিক নদীর তীর এভাবে দখল চলছে। একটি প্রভাবশালী মহল নদী তীরের বিশাল এলাকা দখল করে এসব করছে। ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদী তীরে এমন দখল তাণ্ডব চললেও উপজেলা ভূমি প্রশাসন রয়েছে নির্বিকার।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এবং মানুষের অবিবেচক-অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি হচ্ছে ডুবোচর। সেই চরে বাধা পেয়ে ইলিশ যাচ্ছে ভিন্ন পথে। ডিম ছাড়ছে ‘অন্য বাড়িতে’। সেই ডিম ফুটে বের হওয়া ছানাপোনারা খাবারের খোঁজে এসে জড়ো হচ্ছে ডুবোচরগুলোয়। আসছে অন্য মাছের পোনারাও।
২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আন্ধারমানিক নদীকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। তখন ইলিশের বিচরণ ছিল এই নদীতে। অসংখ্য জেলের জীবিকার উৎস ছিল ইলিশ শিকার। এক যুগ যেতেই এখন নদীটি একেবারে ইলিশ শূন্য হয়ে গেছে।
মূলত এখন আন্ধারমানিকে ইলিশের দেখা পাওয়া স্বপ্নের মতো। জেলেসহ পরিবেশ সংগঠকদের শঙ্কা আন্ধারমানিক নদী ইলিশের অভয়াশ্রমের সুখ্যাতি হারাতে পারে। এজন্য প্রধান সমস্যা মনে করছেন নাব্যতা সঙ্কট। পাশাপাশি দখল-দূষণ-ভরাটও বহুলাংশে দায়ী। পরিবেশ সংগঠক নজরুল ইসলাম এমন শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন।
নদীতীরের বাসিন্দা রহমতপুর গ্রামের বাসিন্দা মন্নাফ চৌকিদার (৬০) জানান, জীবনটাই তার কেটেছে আন্ধারমানিক নদীতে মাছ ধরে। ইলিশের পাশাপাশি অনেক মাছ ধরতেন। জীবিকার প্রয়োাজন মেটাতেন। কিন্তু এখন আর ইলিশ নাই। ছয় বছর আগে ইলিশের জাল পাল্টে এখন বেহুন্দী জালে ছোট্ট মাছ ধরেন। একই দশা ফতেহুপুর গ্রামের হোসেন মুন্সী (৫০) ও নেছার মুন্সীর (৪৮)। দুই-এক বছরে আন্ধারমানিকে ইলিশ পেয়েছেন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাছ না থাকায় আন্ধারমানিকে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা অন্তত ৩৫০ জেলে পরিবারকে উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ বিকল্প পেশায় পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বহু আগে উদ্যোগ নেয়। আন্ধার মানিকের ইলিশের আকালের এটি একটি উদাহরণ হয়ে আছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কলাপাড়া আঞ্চলিক কমিটির সদস্যসচিব, পরিবেশ সংগঠক ও সিনিয়র সাংবাদিক মেজবাউদ্দিন মান্নু তার ভাষ্যমতে, জোয়ারেও থাকে না আন্ধারমানিকের স্রোতের ধারা। পলির আস্তারণে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। দুই পাড় সংকুচিত হয়ে গেছে। দখল করা হয়েছে দুই তীরের প্লাবন ভূমি। করা হয়েছে বাড়ি-ঘর, পুকুর, মাছের ঘের। দশের অধিক ইটভাটা। দূষণ চলছে সমানতালে। পৌরশহরের অধিকাংশ বর্জ্য যাচ্ছে নদীতে। জেগেছে অনেক ডুবোচর। দ্রুত আন্ধারমানিক নদকে খনন করে বাঁচানো ও দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, সাগর মোহনা অঞ্চলে ডুবোচর তথা তীব্র নাব্য সংকটে ইলিশ চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইলিশ চলাচলে গভীর পানির প্রয়োজন কিন্তু ডুবোচরের কারণে নদীতে সেই পরিমাণ গভীরতা না থাকায় সাগর মোহনা দিয়ে ইলিশ প্রবেশ করতে পারে না।