রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন জীর্ণ-শীর্ণ দশা। বছরে বর্ষা মৌসুমে দুই মাসই থাকে তার জৌলুস। তারপর পানি শুকিয়ে শত শত বিঘা জমিতে জেগে উঠে চর। আবাদ হয় ফসল। অসম্ভব হয়ে পড়ে নৌপথের চলাচলও। মাছ ধরতে জাল ফেলার জায়গাটুকু মেলে না জেলেদের। এভাবেই যেন নিমিষে হারিয়ে যায় তার ভরা যৌবন।
এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন ফসলের মাঠ। কোথাও পানি, আবার কোথাও বিস্তৃত ফসলের মাঠ। এক সময় সারা বছরই দেখা মেলেছে এ পদ্মার জৌলুস। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা এ পদ্মা।
জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় (মানাকোসা ও দুর্লভপুর ইউনিয়ন) হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করে। যার সর্বোচ্চ গভীরতা এক হাজার ৫৭১ ফুট (৪৭৯ মিটার)। তবে এর গড় গভীরতা ৯৬৮ ফুট (২৯৫ মিটার)।
এদিকে শিবগঞ্জ উপজেলা পয়েন্ট থেকে পাবনার ঈশ্বরদী হার্ডিঞ্জ সেতু পর্যন্ত দেড় শ’ মাইল জুড়ে পদ্মার জীর্ণ-শীর্ণ দশা। নদীটি এখন যেন মরা খালে রূপ নিতে শুরু করেছে।
চরাঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, ‘দুই মাস ছাড়া বছরের বাকি সময় পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায় পদ্মায়। নৌকাও চলে না ঠিকমতো। হেঁটেই যাওয়া যায় চর এলাকায়।’
এদিকে গবেষকরা বলছেন, ফারাক্কা চুক্তির পর বাংলাদেশ পানি পেয়েছে কেবল বর্ষা মৌসুমে। কিন্তু সারা বছরের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে চুক্তি রক্ষা করেনি ভারত। চুক্তির নামে বাংলাদেশের মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। পদ্মার যৌবন হারিয়ে শাখা-প্রশাখা বড়াল, ইছামতি, পুর্ণভবা, ধলেশ্বরী, আড়িয়ালখাঁ, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, কপোতাক্ষসহ প্রায় ২৫টি নদ-নদীর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হতে চলেছে।
শুধু তাই নয়, পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদী। দ্রুত চুক্তি নবায়ন করে পানির ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা পদ্মাপাড়ের মানুষের সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, ‘উজানে বাঁধ দেয়ার ফলে পদ্মা ছাড়াও এর শাখা উপ-শাখাগুলোও অস্তিত্ব হারাচ্ছে। ভারতের পানি-আগ্রাসীনীতি শুধু এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোকে শুকিয়ে মারেনি, এর প্রভাব পড়েছে এসব নদীর সাথে সংযুক্ত খাল-বিলেও। এ অঞ্চলের বিখ্যাত চলনবিলে (বিল) এক সময় বিস্তৃত পানিরাশি দেখে বুঝার উপায় ছিল না এটা বিল নাকি নদী। সেটিও এখন মৃতপ্রায়।’
এছাড়া বিলকুমলী, বিল হালতি, বিলভাতিয়া, উথরাইল, কুমারীদহ, অঙ্গরাসহ অসংখ্য বিল হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। নদী-খাল-বিল মরে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতিতেও।
এতে হারিয়ে গেছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির দেশীয় মাছ। এদিকে নৌ যোগাযোগ আর নেই। নদ-নদীর বুকে আবাদ হয় ধান, পাট, গমসহ বিভিন্ন ফসল। এতে আবাদের পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে মরুময়তা।
জানা যায়, এবারো প্রায় দুই মাসের জন্য যৌবন এসেছিল পদ্মার। ওপারের বন্যার চাপ সামলাতে প্রতি বছর খুলে দেয়া হয় ফারাক্কার গেটগুলো। বন্যার চাপ কমলে আবারো বন্ধ করে দেয়া হয় কপাটগুলো। শীত মৌসুমের পৌষ মাসেই নদীর পানি পৌঁছেছে তলানিতে। সামনে রয়েছে খরা মৌসুমের চৈত্র-বৈশাখ মাস। এদিকে উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের লোকদের উপজেলা সদরে প্রায় পায়ে হেঁটেই চলাচল করতে হয়।
চকরাজাপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জোগলু শিখদার বলেন, ‘বছরের দুই মাসের মতো আমরা পদ্মায় পানি পাই। বর্তমানে অসংখ্য চর জেগে উঠছে। ফলে প্রমত্তা পদ্মা এখন ফসলের মাঠ।’
নদী গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কখনো পানি পায়নি। এ নিয়ে যৌথ নদী কমিশনেরও তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। বাংলাদেশের মানুষ চুক্তির নামে প্রতারণার শিকার হয়েছে।’
এদিকে রাজশাহী পাউবো থেকে নগরীর বড়কুঠি এলাকায় প্রতিদিন পদ্মার পানির গভীরতা পরিমাপ করা হয়।
পাউবোর দায়িত্বপ্রাপ্ত গেজ রিডার এনামুল হক জানান, ‘ভরা মৌসুমে গত ৫ অক্টোবর পদ্মার পানির সর্বোচ্চ গভীরতা ছিল ১৬ দশমিক ৭০ মিটার। এরপর পানি কমতে শুরু করে। প্রতিদিনই কমছে পানি।’