২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সাভার ছিল এক রক্তাক্ত দিন, এক ইতিহাস। দুপুর যখন ১টা, তখন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের খবর চারদিকের বাতাসে উড়ছিল। দুপুর আড়াইটায় পতিত সরকারের তৎকালীন শেখ হাসিনা পালিয়ে দিল্লি যাওয়ার খবর প্রচার হলে পুলিশ ও তার দোসর ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা সাভার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় নির্বিচারে ছাত্র-জনতার আনন্দ বিজয় মিছিলে গুলিতে অন্তত ৩১ জন শাহাদাত বরণ করেন। আর আহত হয়েছে শতাধিক।
৫ আগষ্ট শহীদরা হলেন- সাভার পৌর এলাকার মুক্তির মোড়ে শহীদ সাফওয়ান আক্তার সদ্য, শহীদ তানজির খান মুন্না, শহীদ মুজাহিদ, শহীদ আরিফুর রহমান রাসেল, শহীদ সুমন হাসান, শহীদ মো: মিঠু, শহীদ জামাল হোসেন শেখ, শহীদ শ্রাবণ গাজী, শহীদ শেখ শফিকুল ইসলাম, শহীদ সুজন, শহীদ শফিকুল ইসলাম ও শহীদ মো: আহাদ সৈকতসহ ১৩ জন শহীদ এবং আশুলিয়ার বাইপাইলে শহীদ হামিদ, শহীদ মো: মিজানুর রহমান, শহীদ মো: সবুজ, শহীদ মো: জাহিদুল ইসলাম, শহীদ আশরাফুল ইসলাম, শহীদ রাসেল গাজী, শহীদ বায়েজিদ, শহীদ মো: আবুল হোসেন, শহীদ আস-সাবুর, শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজল, শহীদ এমএম হোসাইন, শহীদ আরাফাত মুন্সিসহ ১৮জন শহীদ।
এর আগে ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট বেলা ১১টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া বিশাল মিছিল গণভবনের দিকে এগোতে থাকে। আশুলিয়ার বাইপাইলে দিক থেকে আসা ছাত্র-জনতা যুক্ত হলে মিছিলটির গতি আরো বাড়তে থাকে। মিছিলসহ পদযাত্রাটি সাভার বাসস্ট্যান্ডের নিকট পৌঁছলে তৎকালীন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফি, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুর রহমান, সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান, আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যের বাধার সম্মুখীন হয় মিছিলটি। সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সকাল থেকেই শক্ত অবস্থান নেয় পুলিশ। কোনো মিছিল যাতে ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সংযোগ সড়ক আর গলিগুলোতে থেমে থেমে ছোঁড়া হয় কাঁদানে গ্যাস। এমনকি প্রাণঘাতি গুলি। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে অংশ নেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। যখন জাহাঙ্গীরনগর থেকে আসা মিছিলটি সাভার বাসস্ট্যান্ড পৌঁছায়। তখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ সময় সাভার বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় শহীদ হন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টার্সের ছাত্র পৌর এলাকার ডগরমোড়ার আবদুল কাইউম, কলেজছাত্রী নাফিসা হোসাইন মারওয়াসহ তিনজন। একই সময় আওয়ামী সন্ত্রাসী, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাভার বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় ব্যাপক গুলি বর্ষণ করে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ছাত্র-জনতা পুনরায় সংগঠিত হয়ে পাকিজা মোড় ও সাভার বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নেয়। এরই মধ্যে সেনাপ্রধান দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, ওই খবর মুহূর্তের মধ্যে মিছিলে ছড়িয়ে যায়। মিছিলটি ঢাকার দিকে এগোতে চাইলে পুলিশের তীব্র বাধার মুখে পড়ে। কাঁদানে গ্যাস, ছোঁড়া গুলিতে রণক্ষেত্র গোটা সাভার বাসস্ট্যান্ড। শতাধিক পুলিশ অংশ নিয়েছিল এই আক্রমণে। বেশিভাগই সাভার থানার। বাকিরা এসেছিলেন আশপাশের থানাগুলো থেকে। কাঁদানে গ্যাসেও আন্দোলনকারীরা পিছু হটেননি। তাদের আটকাতে এবার প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি আরো অশান্ত হয়ে উঠে। পরে যখন দুপুর আড়াইটা তখন পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহন করা বিমান দেশের সীমানা ছাড়ছিল, তখনই সাভারের রাস্তাগুলোর চিত্র ছিল ভিন্ন। মুহূর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ছাত্র-জনতার উত্তাল ঢল, লোকারণ্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ যেন এক নতুন বাংলাদেশের পেয়েছে। ঠিক ৩টার পর থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতে শুরু হয়। পালিয়ে যাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখনও মহাসড়কে মানুষ তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। জনতার ঢল বিকেল ৪টার পর যখন পৌর এলাকার সাভার থানা রোডের মুক্তির মোড় থেকে মিছিল নিয়ে থানার দিকে যাচ্ছিল পরিস্থিতি তখনই ভয়াবহ রুপ নেয়। পুলিশ নির্বিচারে বিভিন্ন শ্রেণি পেশা আর বয়সের মানুষের উপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করলো। রক্তের বন্যা বয়ে যায় মুক্তিরমোড়ের সংযোগ সড়কটিতে। একে একে লাশ আর লাশ এবং আহতদের সাভারের এনাম মেডেক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে থাকে। কাউকে রিকশায়, কেহ বা হাতে হাতে ধরে অনেকে আবার কাঁধে করে হাসপাতালে নিতে থাকে। গুলি লাগে মাথায়, গলায়, বুকে, কোমরে, এমনকি উরুতেও। যখন প্রাণ চলে যায়, আর ইতিহাসে চিরকাল রয়ে যায় এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। ওই দিন গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিল থানার নিকটবর্তী দু’টি হাসপাতাল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রক্তপাত বন্ধ করে সংকটাপন্ন রোগীদের পাঠানো হয় এনাম মেডিক্যাল হাসপাতালে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সন্ধ্যার দিকে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের চাপ আর সামলাতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে জরুরি বিভাগের বাইরে হুইলচেয়ারে চলে চিকিৎসা। আহতদের কিছু আশুলিয়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হলেও বেশিভাগই গুলিবিদ্ধ হন সাভার পৌর এলাকায়। বেশিভাগই বিক্ষোভকারীরা নিজেদের ফোনে ধারণ করেছেন। তারা গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন। বিকেল ৪টা থেকে ৬টা ২ ঘণ্টার ব্যবধানে কিভাবে এতগুলো তরতাজা প্রাণকে গুলি করে হত্যা করা হয়? ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার থানা বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন গলিটি, যেখানে এক কিলোমিটার এগোলেই সাভার থানা এবং এই গলিতেই সবচেয়ে বেশি হতাহত ঘটেছিল। সাভারে সংঘর্ষ চললেও রাজধানীর পরিস্থিতি তখন ভিন্ন। গণভবনে হাজারো জনতার উল্লাস। বিজয়ের খবর পুলিশের কানেও পৌঁছেছে। পুলিশ থানার দিকে পিছু হটতে থাকে। কিছু পুলিশ সদস্যরা সাভার থানা সংলগ্ন বংশাই নদীর তীরে পোশাক রেখে সাতরে ধামরাইয়ের ফুড নগর হয়ে পালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে থানার চারপাশ ছাত্র জনতা ঘেরাও করে রাখে। উপয়ান্ত না দেখে সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসারসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুলি করতে করতে নবীনগর অভিমুখে পালাতে থাকে। গাড়ি বহরের পাশাপাশি অনেকে পায়ে হেটে যায়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে নবীনগর অভিমুখে যেতে যেতে তারা শত শত রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলটি সাভার থানা রোড ও সাভার বাসষ্ট্যান্ডে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। তাদের এলোপাথারি গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। আহতদের অনেকেই এখনো পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। দেশের জন্য তারা বুক চিতিয়ে দিয়েছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাভারে প্রথম শহীদ হয় ১৮ জুলাই শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। পুরো ৩৬ জুলাইয়ে শহীদের সংখ্যা ৪৩ জন। বিভিন্ন সূত্র থেকে এ সংখ্যা জানা গেলেও দীর্ঘ এক বছরে সাভার উপজেলা প্রশাসন শহীদের সঠিক তালিকা এবং আহতদের তালিকা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন।
৫ আগস্টের সাভার গণহত্যা আমাদের ইতিহাসে এক অন্ধকার দিন ছিল। সে দিন যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন তরুণ ছাত্ররা, সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, যাদের চোখে ছিল একটি স্বপ্ন-একটি উন্নত, সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ। ওই দিন, হাসিনা পালানোর পর সাভারের রাস্তায় যে রক্তের বন্যা বইয়ে গিয়েছিল, তা কেবল একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ফল নয়, ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের সঠিক তালিকা জানতে চাইলে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো: তৌহিদ আল-হাসান নয়া দিগন্তকে জানান, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ এবং আহতদের সঠিক তালিকা প্রকাশ করতে আমরা কাজ করছি। গ্যাজেটের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।



