২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। সারাদেশে অস্থির সময়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে যখন উত্তাল দেশ, তখন আগুনে ঝলসে যায় ছয়টি তরতাজা প্রাণ। সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো থামেনি পরিবারের কান্না।
ফুলবাড়ী উপজেলার বড়লই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি হাবিলদার জিয়াউর রহমানের পরিবারে এই কান্না। ছেলের কবরের পাশে বসে প্রতিদিন বাবা-মা শুধু একটা কথাই বলেন, ‘বাবা, তুই কেন গেছিস?’
সেদিন লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুমন খানের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর গভীর রাতে চারতলা ভবনের বাথরুম ও মেঝে থেকে ছয়টি পুড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার করা হয়। সেই ছয়জনের একজন ছিল মাত্র ১৭ বছরের রাদিফ হোসেন রুশো। তখন সে লালমনিরহাট ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পরিবারের একমাত্র সন্তান, স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবা করার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রুশোর বাবা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমি বিজিবিতে চাকরি করতাম। ১২ বছর চাকরির সময় বাকি ছিল, কিন্তু ছেলের মৃত্যু আমাকে আর কাজ করতে দেয়নি। স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছি। আজ কবরের ধারে ছেলের ছবির সামনে বসে থাকি। ওর কণ্ঠ, ওর হাঁটার শব্দ আজও শুনতে পাই মনে হয়।’
রুশোর মা রশিদা বেগম এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না তার ছেলে আর নেই। অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন মনে হয় আমার ছেলে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বলে, ‘মা আমি এসেছি’। আমি ছেলের জামা-কাপড় গুছিয়ে রেখেছি। কেউ কিছু নড়তে পারবে না। রাতে ঘুম ভেঙে কবরের পাশে যাই, ছবি দেখি আর কাঁদি। কেউ কি বলে, একমাত্র ছেলেকে এভাবে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে হয়?’
৯০ ছুঁই ছুঁই দাদু মোখলেছুর রহমান। বয়সের ভারে কাবু হলেও নাতির কথা বলতেই চোখ পানিতে ভরে যায়। বলতে থাকেন, ‘রুশো ছিল আমার চোখের আলো। নাতিটা আমার খুব আদর করত। এখনো ওর ছবি বুকে নিয়ে ঘুমাই। ওর কবরের পাশে বসে আল্লাহকে বলি, ‘আমারে নিয়ে যা, রুশোরে দিয়া যা।’
এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই ঘটনায় এখনো দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান বিচার হয়নি। রুশোর পরিবার বিচার চায়, ন্যায্য বিচার। তারা চায়, এমন মৃত্যু আর কোনো মা-বাবাকে দেখতে না হোক।
রুশোর শূন্য ঘর, স্তব্ধ উঠোন আর কবরের পাশে মা-বাবার নীরব কান্না আজো বলে যায়, এক অন্যায়ের গল্প। যে গল্পে নেই কোনো রাজনীতি, নেই ষড়যন্ত্র, আছে শুধু এক নিঃস্ব পরিবারের সন্তান হারানোর চিরন্তন বেদনা।