গাজীপুরে ইমামের মৃত্যু নিয়ে যা জানাল জিএমপি পুলিশ

নিহত রইস উদ্দিন চাঁদপুরের মতলব উপজেলার বাদশা মিয়ার ছেলে। তিনি গাজীপুরের হায়দরাবাদ আখলাদুল জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন।

মো: আজিজুল হক, গাজীপুর মহানগর

Location :

Gazipur
নিহত রইস উদ্দিন
নিহত রইস উদ্দিন |নয়া দিগন্ত

গাজীপুর মহানগরীর হায়দরাবাদ এলাকায় বলৎকারের অভিযোগে স্থানীয় জনগণ কর্তৃক আইনের কাছে সোপর্দ একজন ইমামের কারাগারে মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি মহল ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আবেগকে পুঁজি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম অপপ্রচার ও উস্কানিমূলক গুজব ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ও বিক্ষোভ সৃষ্টি করে দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারার প্রেক্ষাপটে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধ দক্ষিণ বিভাগ বুধবার (এপ্রিল) রাত ১১টায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আলোচিত ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছে।

তাতে বলা হয়, পুলিশ উভয় ঘটনা (বলাৎকার ও ইমামের মৃত্যু) গুরুত্বসহ তদন্ত করছে। পূবাইল থানার সংশ্লিষ্ট মামলাটি তদন্তাধীন আছে এবং ঘটনা সংক্রান্তে স্থানীয় সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল হতে অভিযোগের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণাদি ও আলামত জব্দতালিকামূলে জব্দ করা হয়েছে। মামলার আসামি কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার পাঁচজন ভিকটিম নারী ও শিশু নির্যাতন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর ২২ ধারা মোতাবেক বুধবার (৩০ এপ্রিল) আদালতে তাদের জবানবন্দি দিয়েছে। অপরদিকে একটি সাধারণ ডায়েরিমূলে ইমামের মৃত্যুর ঘটনাটিও তদন্ত করা হচ্ছে। মারধরের কারণে ইমামের মৃত্যু হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারসহ সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও প্রেস ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করা হয়।

গণপিটুনির ঘটনাগুলো খুবই দুঃখজনক মন্তব্য করে জিএমপি দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন বলেন, ‘গণপিটুনি বা মবজাস্টিস নিয়ন্ত্রণে গাজীপুর মহানগর পুলিশ দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে যার কারণে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পুরোপুরি বন্ধের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের ব্যক্তিসচেতনতার পাশাপাশি সকল মহলকে দায়িত্ব সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।’

প্রেস ব্রিফিংয়ে উপ-পুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন বলেন, ‘সম্মানিত আলেম সমাজের একাংশের কেউ কেউ ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আবেগকে পুঁজি করে তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করার মানসে দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন, যা খুবই দুঃখজনক। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই লাশ নিয়ে থানা ঘেরাও ও অবরোধ, বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ করে তারা মিছিল প্রতিবাদ সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম অপপ্রচার ও উস্কানিমূলক গুজব প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি ও বিক্ষোভ তৈরি করছেন। যা স্বাভাবিক আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে প্রতীয়মান।’

ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিরবণ তুলে ধরে উপ-পুলিশ কমিশনার জানান, গত ২৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১১টায় হায়দরাবাদ এলাকার স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া যায় যে, পূবাইল থানাধীন হায়দরাবাদ সাকিনস্থ আখলাছ জামে মসজিদের ইমাম রইজ উদ্দিন (৩২) শিশু বলৎকারের ঘটনায় স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক আছেন। পূবাইল থানা পুলিশের টহল টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখতে পায় যে, শিশু বলৎকারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রায় ২০০-৩০০ লোকজন ইমাম রইজ উদ্দিনকে মারধর করে আটক করে রেখেছে। পুলিশের টহল টিম স্থানীয় লোকজনদের কাছ থেকে ইমাম রইজ উদ্দিনকে আহত অবস্থায় পুলিশ হেফাজতে নিয়ে তাৎক্ষনিক চিকিৎসার জান্য টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেয়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার কর্তৃক চিকিৎসা প্রদান শেষে পুলিশের টহল টিম ২৭ এপ্রিল দুপুর পৌনে ২টায় ইমাম রইজ উদ্দিনকে পূবাইল থানায় নিয়ে যায়। এর আগেই ২৭ এপ্রিল দুপুর সোয়া ১২টায় উক্ত শিশু বলৎকারের ঘটনায় ভিকটিম সাদিকুর রহমান (১৪) এর বাবা মাইনুদ্দিন ইমাম রইজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে পূবাইল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারনামীয় আসামি রইজ উদ্দিনকে বিধি মোতাবেক ২৭ এপ্রিল বেলা সোয়া ২টায় পূবাইল থান থেকে আদালতে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে সময়ে আদালত আসামী রইজ উদ্দিনকে গাজীপুর জেলা কারাগারে প্রেরণ করেন। আসামি রইজ উদ্দিন জেলা কারাগারে থাকাকালীন ২৮ এপ্রিল রাত ৩টায় অসুস্থতা বোধ করলে কারাকর্তৃপক্ষ তাকে গাজীপুরস্থ শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক রইজ উদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো: শহীদ উল্লাহ সদর থানা পুলিশের এসআই মিজানুর রহমানের উপস্থিতিতে ২৮ এপ্রিল দুপুর ১২টায় হাসপাতাল মর্গে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করেন এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার এ এন এম আল মামুন লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন।

থানায় ইমামের স্ত্রীর অভিযোগ : এদিকে গণপিটুনির শিকার ইমামের মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যা বলে দাবি করেছে পরিবার। এ ঘটনায় সোমবার (২৮ এপ্রিল) রাতে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে নিহত ইমামের স্ত্রী সাজেদা বেগম থানায় লিখিত একটি অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বিরোধীপক্ষের একজনের ছেলেকে বলাৎকারের নাটক সাজিয়ে তার স্বামীকে গাছের সাথে বেঁধে মারধর করা হয়। বিবাদীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বুক, পিঠ, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন। একপর্যায়ে মাথার চুল কেটে এবং গলায় জুতার মালা দিয়ে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।

লিখিত অভিযোগে আরো বলা হয়, ঘটনার বিষয়টি পরিবারকে না জানিয়ে চার ঘণ্টা পর পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অতিরিক্ত মারধরের কারণে ওই দিন রাতেই কারাগারে তার স্বামী মারা যান।

১০৪ নাগরিকের বিবৃতি : অপরদিকে রইজ উদ্দিন হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ১০৪ নাগরিক। বুধবার রাতে মোহাম্মদ আবু সাঈদ, রাফসান আহমেদ ও এ এইচ এম শাহীনের পাঠানো বিবৃতিতে এসব কথা জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, মাওলানা রইজ উদ্দিনের এই মৃত্যুতে সরাসরি দু’টি বিষয় জড়িত- মব ভায়োলেন্সে অকথ্য নির্যাতন আর পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের নির্মম আচরণ। স্বৈরাচার পতনের আট মাস পরও এমন মব ভায়োলেন্স, পুলিশের নির্মম ও অমানবিক আচরণ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। কেন আমরা পুলিশি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই তার একটি দৃষ্টান্ত এই ঘটনা। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

বিবৃতি আরো বলা হয়, স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে একজন নাগরিকের এমন নির্মম মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। ন্যাক্কারজনক ঘটনায় জড়িত মব ভায়োলেন্সের উদ্যোক্তা এবং অংশগ্রহণকারী, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা থানা পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষ-প্রত্যেককে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে আহলে সুন্নাতের বিক্ষোভ : এদিকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার কেন্দ্রীয় সদস্য ও ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি, ইমাম ও খতিব মাওলানা মুহাম্মদ রইস উদ্দিনকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যার প্রতিবাদে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের দাবিতে বুধবার দুপুরে টঙ্গীতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত। টঙ্গী প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত মানবন্ধনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুফতী গিয়াস উদ্দিন আত্ব তাহেরী। পরে বিকেলে গাজীপুর প্রেসক্লাবের সামনেও তারা একই দাবিতে পৃথক মানববন্ধন করেন। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন মাওলানা মাসুদ হোসাইন আল কাদরী, পীরে তরিকত ওয়ালি উল্লাহ আশেকী, পীরে তরিকত আলহাজ্ব ছিদ্দুকুর রহমান হানাফী, মুফতী শাহ হামেদ রেজা আজহারী, মুফতী রায়হানুল মোস্তফা, মুফতী খাজা শাহ মাহমুদ রেজা, মাওলানা মমিনুল ইসলাম, মাওলানা নজরুল ইসলাম, মাওলানা হাফেজ রাব্বানী, মাওলানা মিরান শাহ, মাওলানা নুর উদ্দিন, মাওলানা মাহমুদ হোসাইন, মাওলানা আমিনুল ইসলাম ওয়ালী, মাওলানা শামছুদ্দিন রিজন, মাওলানা মাসুদ হোসাইন প্রমুখ।

সভায় বক্তারা বলেন, ‘ছাত্রসেনার নেতা মাওলানা মো: রইস উদ্দিন গত ২৬ এপ্রিল গাজীপুর থেকে অসংখ্য লোকজন নিয়ে ঢাকার সমাবেশে এসেছিলেন। এ অপরাধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনা কারা ঘটিয়েছে তা আমাদের কাছে ‘স্পষ্ট’। যারা এ হত্যাকাণ্ড করেছে, যারা এ দেশের মধ্যে ইসলামের নাম দিয়ে বিভিন্ন মাজারে ভাঙচুর করে তাদের বলে দিতে চাই, আমরা সুন্নিরা বারবার রক্ত দিয়েছি, প্রয়োজনে সুন্নিরা রইস উদ্দিনের জন্য আবারো রক্ত দিতে রাজপথে নামব।’

নিহত রইস উদ্দিন (৩৫) চাঁদপুরের মতলব উপজেলার বাদশা মিয়ার ছেলে। তিনি গাজীপুরের হায়দরাবাদ আখলাদুল জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন।