পদ্মায় বাড়ছে পানি, ভাঙন আতঙ্কে দৌলতদিয়া লঞ্চ-ফেরিঘাটসহ সহস্রাধিক পরিবার

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই নদী ভাঙন রোধে সরকারি-বেসরকারি ও স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের নানা ধরনের পরিকল্পনার আচ্ছাস ও প্রতিশ্রুতি থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই বাস্তবায়ন হয়নি।

মেহেদুল হাসান আক্কাস, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী)

Location :

Rajbari
নদী ভাঙন
নদী ভাঙন |নয়া দিগন্ত

শুষ্ক মৌসুম শেষে বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও ভাঙন রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় আতঙ্ক ও ক্ষোভে ফুঁসছেন পদ্মা পাড়ের বাসিন্দারা।

পদ্মার পানি দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। পদ্মা নদীর দৌলতদিয়া পয়েন্টের পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ পাঠক সূত্রে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে দৌলতদিয়া পয়েন্টে প্রায় দেড় ফুট পানি বেড়েছে। নদীর পানি বাড়তে থাকায় এ অঞ্চলের মানুষ বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি নিয়ে রাত-দিন ভাঙন আতঙ্কে সময় পার করছেন। তাছাড়া বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর বর্ষার শুরুতেই পদ্মার পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ও বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হওয়ায় স্থানীয় জনমনে এ আশঙ্কা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

বিগত ২০ বছরে বর্ষা মৌসুমে পদ্মার ভাঙনে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার পরিবার ও তাদের ঘর-বাড়ি হাজার হাজার একর ফসলি জমি, হাট-বাজার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই নদী ভাঙন রোধে সরকারি-বেসরকারি ও স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের নানা ধরনের পরিকল্পনার আচ্ছাস ও প্রতিশ্রুতি থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই বাস্তবায়ন হয়নি। এতে করে জনমনে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।

যেকোনো মুহূর্তে নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে দৌলতদিয়ার কয়েকটি ফেরিঘাট ও লঞ্চ ঘাট। এছাড়া এর পাশের সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, একটি মসজিদ ও এ অঞ্চলের সাত শতাধিক পরিবার ও তাদের ভিটেমাটিসহ ফসলি জমি।

বিগত তিন বছর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় একদিকে তারা ঘর-বাড়ি সরাতে ও মেরামত করতেও পারেনি। অন্যদিকে, সরকার থেকে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। এতে করে স্থানীয়দের মনে উভয় সঙ্কট কাজ করছে।

রাজবাড়ী জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড, গোয়ালন্দ উপজেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দৌলতদিয়াঘাট এলাকায় ভাঙন রোধে মহাপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে ওই প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও কয়েক দফায় নকশা পরিবর্তনে ব্যয় বেড়ে দাড়িয়েছিল প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। দৌলতদিয়ায় ৬ কিলোমিটার ও পাটুরিয়া ২ কিলোমিটার মিলে দু’টি ঘাটে মোট ৮ কিলোমিটার নদী রক্ষা বাধসহ আধুনিক নৌ-বন্দরের আওতায় আনতে বিআইডব্লিউটিএ কতৃপক্ষ ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করেছিল। তৎকালীন সময়ে নৌ-বন্দরের জন্য দৌলতদিয়ায় প্রায় ৩০ একর জমি ওই কতৃপক্ষ অধিগ্রহণ করে। এরপর থেকে ওই জমির মালিকদের নতুন ভবন তৈরি বা অপসারণ করা এমনকি কোনো গাছপালা কর্তনও নোটিশের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

২০২৪ সালে প্রহসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওই প্রকল্পটির কাজ স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে ওই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন হয়নি। এতে করে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা বুঝে পায়নি জমির মালিকরা। পাশাপাশি নদী রক্ষা বাঁধও নির্মিত হয়নি।

সরেজমিনে শুক্রবার (২৩ মে) ও শনিবার (২৪ মে) দুপুরে দেখা গেছে, দৌলতদিয়া ৭ নম্বর ফেরিঘাটে ছাত্তার মেম্বর পাড়ায় সিদ্দিক কাজীর পাড়া শাহাদাত মেম্বর পাড়ায় থেমে থেমে পদ্মার পাড় ভাঙছে। এছাড়া ৪ নম্বর ফেরিঘাটে একটি মসজিদ, লঞ্চঘাট এলাকা, শাহাদত মেম্বর পাড়া, ঢল্লা পাড়া, ইদ্দিস মিয়ার পাড়া, বদন মৃধার পাড়ার সহস্রাধিক পরিবার ও হাজার হাজার একর আবাদি অনাবাদি জমি ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে।

এ সময় আরো দেখা গেছে, ৭ নম্বর ফেরিঘাটে পন্টুন সংলগ্ন নদীর পাড়ে অবস্থিত মোসলেম উদ্দিন এর দোকানটি প্রায় নদীগর্ভে চলে গেছে। এছাড়া মুক্তার মণ্ডল, মামুন শেখ, জেকের শেখ, আলম মোল্লা, নিপা শেখ, হানিফ মোল্লা, শামীম শেখ, নিজাম প্রামানিক, গোলাপ খাঁ-সহ কয়েকটি ঘাটের দোকানগুলো ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

এ সময় ৬ নম্বর ফেরিঘাটের দোকানদার আঃ বারেক মৃধা, তার প্রতিবেশী মজিবর মণ্ডল, আলমগীর খান, মোহাম্মদ সিদ্দিক মোল্লা, সরোয়ার মোল্লা, রাশেদুল প্রামানিক, নূরু শিকদার, বাবলু শেখ-সহ একাধিক ব্যক্তি হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলে নদী ভাঙন প্রতিরোধে নানান ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষে আর কারো কোনো কিছুই মনে থাকে না। কোনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হয় না। এতে করে প্রতি বছর আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। অথচ কারো কোনো দৃষ্টি গোচর হচ্ছে না। নদী ভাঙন রোধে বিআইডব্লিউটিএ কতৃপক্ষ প্রায় চার বছর আগে আমাদের জমি-জমা অধিগ্রহণ করে নোটিশ দিয়েছিল। আমাদের বাড়ি-ঘর গাছপালাসহ ক্ষতিপূরণ দিয়ে ভেঙে দেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। এখন আমরা ভাঙনের মুখোমুখি। আবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে লোকজন আসা শুরু হয়েছে। কার কথা বিশ্বাস করব। আমরা মরে গেলেও কারো কিচ্ছু আসে যায় না।

এ বিষয়ে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল আমিন বলেন, দৌলতদিয়া পয়েন্টে পদ্মার পাড় ভাঙন রোধে দ্রুত সময়ে জিও ব্যাগ ফেলা হবে। তবে এখানে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট আধুনিকায়নে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ একটি মেঘা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে তেমন কিছুই বলতে পারছি না।