বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

৪ আগস্ট গোলাপগঞ্জে এক দিনে নিহত হন ছয়জন

আজ ৪ আগস্ট নিহতদের পরিবারে দিনগুলো বেদনার হয়ে উঠেছে। এই দিনে পুলিশ-বিজিবি ও আওয়ামী লীগের গুলিতে গোলাপগঞ্জের শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন।

সৈয়দ জেলওয়ার হোসেন স্বপন, গোলাপগঞ্জ (সিলেট)

Location :

Golapganj
গোলাপগঞ্জে শহীদ সাতজন
গোলাপগঞ্জে শহীদ সাতজন |নয়া দিগন্ত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদ সরকারের পুলিশ-বিজিবি ও আওয়ামী লীগের গুলিতে এক দিনে নিহত হয়েছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জের ছয়জন। আজো নিহতের পরিবারের কান্না থামেনি। সন্তান হারানোর বেদনা আজো ভুলতে পারেননি শহীদ পরিবাররা।

আজ ৪ আগস্ট নিহতদের পরিবারে দিনগুলো বেদনার হয়ে উঠেছে। এই দিনে পুলিশ-বিজিবি ও আওয়ামী লীগের গুলিতে গোলাপগঞ্জের শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন।

সিলেটের গোলাপগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাতজন শহীদ হলেও গোলাপগঞ্জে পুলিশ-বিজিবি ও আওয়ামী লীগের গুলিতে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট এক দিনে নিহত ছয়জন নিহত হয়েছেন। আর ৫ আগস্ট সিলেট শহরের কিন সেতুর কাছে আলী আমজদ ঘড়ির পাশে পুলিশের গুলিতে নিহত একজনসহ গোলাপগঞ্জের সাতজন নিহত হন।

শহীদরা হলেন উপজেলার নিশ্চিন্ত গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে মো: নাজমুল ইসলাম, বারকোট গ্রামের মরহুম মকবুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন, শিলঘাট গ্রামের মো: কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ, রায়গড় গ্রামের ছুরাই মিয়ার ছেলে জয় আহমদ, ঘোষগাঁও গ্রামের মবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন, দত্তরাইল গ্রামের আলা উদ্দিনের ছেলে মিনহাজ আহমদ ও ঢাকাদক্ষিণ রায়গড় গ্রামের মো: রফিক উদ্দিনের ছেলে মো: পাবেল আহমদ কামরুল।

কোটা সংস্কারের দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে ঢাকা শহর। কোটা আন্দোলনে জুন মাসে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। জোরদার হয় আন্দোলন। এরই মধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বদলে যায় দৃশ্যপট।

কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাই ২০২৪ থেকে সমগ্র দেশে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠে। সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাজপথ কাপিয়ে তুলেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে কোটা সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবির পরিবর্তে চলে আসে এক দফা দাবি। ফ্যাসিস্ট সরকারের পদত্যাগের দাবি। সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অন্যরকম রূপ নেয়।

১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত হাজার হাজার ছাত্র-জনতা পুলিশ ও আওয়ামী লীগের দোসরদের হামলায় আহত হন। নিহত হন হাজারো ছাত্র-জনতা। রাজপথে রক্তের বন্যা ভেসে যাচ্ছে তবুও আন্দোলন থামাননি ছাত্র-জনতা। ৪ আগস্ট সারাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে। প্রতিটি জেলা, উপজেলায় আন্দোলনে যার যা কিছু আছে তা নিয়েই রাজপথে প্রতিরোধ করতে থাকেন। পুলিশ-বিজিবি ও আওয়ামী লীগের দোসররা আন্দোলন প্রতিহত করতে গুলি ছুড়িতে শুরু করে দেশের বিভিন্নস্থানে অনেক ছাত্র-জনতা মারা যান।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশের ন্যায় সিলেটের গোলাপগঞ্জের ছাত্র-জনতা বসে থাকেননি। একদিকে উপজেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারার মাধ্যমে কারফিউ জারি করেন। অন্যদিকে গোলাপগঞ্জের ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা কারফিউ ভেঙে সারাদেশের ন্যায় গোলাপগঞ্জের ছাত্র-জনতা প্রতিদিনের ন্যায় ৪ আগস্ট সকাল থেকে উপজেলা সদর, ঢাকাদক্ষিণ বাজার, ভাদেশ্বরসহ বড়বড় বাজারে আন্দোলনের জন্য অবস্থান নেয় তারা।

৪ আগস্ট সকাল অনুমান ৯টার দিকে উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ বাজারে বিজিবির একটি টহল টিম নোহা নিয়ে টহল দেয়ার সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে বাঁধা দেয়। উত্তপ্ত হয়ে উঠেন ছাত্র-জনতা। হামলা চালায় বিজিবির ব্যবহৃত নোহা গাড়িতে। আত্মরক্ষার্থে বিজিবি রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠে ঢাকাদক্ষিণ বাজার। পরে বিজিবি-পুলিশ আন্দোলনে রাবার বুলেটের পাশাপাশি বুলেট নিক্ষেপ করতে থাকে। শতশত ছাত্র-জনতা আহত হতে থাকেন। এতে করে ছাত্রদের আন্দোলনে এলাকার মানুষজন ও অভিভাবকরা জড়িয়ে পড়ে পুলিশ-বিজিবি ও আওয়ামী লীগদের ধাওয়া করতে শুরু করেন। তীব্র হয়ে উঠে গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণ বাজারের ছাত্র-জনতার আন্দোলন। পাল্টা ধাওয়া ও গুলি ছুড়তে থাকে বিজিবি। এতে শতাধিক ছাত্র-জনতা আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে স্থানীয়রা এবং ছাত্র-জনতা ঘেরাও করে ফেলে ঢাকাদক্ষিণ বাজারে বিজিবি ও পুলিশদের।

বিজিবি পালিয়ে গোলাপগঞ্জের দিকে আসার সময় মধ্যখানে বারকোট ও ধারাবহর এলাকায় গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সম্মুখে স্থানীয় জনতা রাস্তা ব্যারিকেট দিয়ে এলাকার মসজিদে মাইকিং করতে থাকলে স্থানীয়রা হাতের কাছে যা পেয়েছে তা নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সম্মুখে সিলেট-ঢাকা দক্ষিণ সড়ক বন্ধ করে পুলিশ-বিজিবিকে ঘেরাও করে ফেলে। পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে ও আত্মরক্ষার্থে সরাসরি গুলি নিক্ষেপ করতে থাকে বিজিবি। এতে ঘটনা স্থলে নিহত হন তাজ উদ্দিন ও নাজমুল ইসলাম, সানি আহমদ। আহত হন জয় আহমদসহ প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন। গুরুতর অবস্থায় জয় আহমদকে সিলেট বেসরকারি হাসপাতাল ইবনে সিনায় ভর্তি করার কিছুক্ষণ পরেই সেও মারা যায়।

উপজেলার বারকোট এলাকায় তিনজন ঘটনাস্থলে নিহত ও সিলেটে হাসপাতালে নেয়ার পর আরো একজন নিহত হওয়ার বিষয়টি চারদিকে চাউর হলে গোলাপগঞ্জ উপজেলা সদর আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ছাত্র-জনতা গোলাপগঞ্জ সদর থেকে বিজিবি ও পুলিশকে আক্রমণ করতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আসে ছাত্র-জনতা। অপর দিকে ধারাবহর ও বারকোট এলাকা থেকে বিজিবিদের ধাওয়া শুরু করতে থাকেন।

বিজিবি-পুলিশ গুলি ছুড়ে ছুড়ে আত্মরক্ষার্থে গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদে আশ্রয় নেন। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখার পর সেনাবাহিনী ও পুলিশের সহায়তায় বিজিবি ও অপর পুলিশদের উপজেলা পরিষদ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়।

এদিকে উপজেলা হাসপাতালের সামনে ঘটনাস্থলে তিনজন নিহত হন এবং ওই ঘটনাস্থলের আরো একজন সিলেট বেসরকারি হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। চারদিকে চারজন মারা যাওয়ার সংবাদ পেয়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলা সদর আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ছাত্র-জনতা গোলাপগঞ্জ মডেল থানা ঘেরাওসহ মিছিল শুরু করে। ওই মিছিল ও থানা ঘেরাও করার বিষয়টি ছত্রভঙ্গ করতে স্বৈরাচারের বাহিনী ছাত্র-জনতার উপর গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় তাদের ছুড়া গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন গৌছ উদ্দিন ও মিনহাজ আহমদ। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিজিবি-পুলিশ ও সেনাবাহিনী আরো কঠোর হয়ে উঠে ছাত্র-জনতার উপর। পরিস্থিতি অবনতি দেখে ছাত্র-জনতা দিগ্‌বিদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ সময় অনেকেই গুলিতে আহত হন। আহতদের শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আজ সেই শোকাবহ ৪ আগস্ট স্বৈরাচার সরকার বাহিনীর নিক্ষেপ করা গুলিতে গোলাপগঞ্জবাসী ছয়জন তরুণ ও যুবকদেরকে হারিয়েছেন। ছয়টি পরিবারের সন্তান হারানো, বাবা হারানো, স্বামী হারানো, ভাই হারানোর শোকাবহ দিন। আজ গোলাপগঞ্জের জন্য একটি কালো অধ্যায়।

এদিকে ঘটনার এক বছর হলেও দৃশ্যমান কোনো আসামী পুলিশ এখনো আটক করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের দোসরা গোলাপগঞ্জ উপজেলা সদরে চলাচল করতে দেখা যায় বলে সচেতন মহলের অভিযোগ। এদিকে নিহত ও আহতদের পক্ষ থেকে গোলাপগঞ্জ থানা ও আদালতে মামলা করা হলেও মডেল থানার ওসি মনিরুজ্জামান মোল্লা রহসস্যজনক কারণে আজো দৃশ্যমান কোনো আসামি গ্রেফতার করেননি।

এ নিয়ে গোলাপগঞ্জবাসী ক্ষুব্ধ। অপরদিকে এখন পর্যন্ত মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি। যদিও ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটররা দু’বার গোলাপগঞ্জে এসে তদন্ত করে গিয়েছেন। আজকের গোলাপঞ্জের এই শোকাবহ দিনে গোলাপগঞ্জবাসী ও উপজেলার বিভিন্ন মহল হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় এনে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।