মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় চলতি মৌসুমে আগাম সবজি ও ভুট্টাসহ অর্থকরী ফসলের আবাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে বিষবৃক্ষ তামাকের আবাদ। কৃষি বিভাগ থেকে চাষিদের নানা প্রণোদনার আওতায় আনলেও স্বল্পমেয়াদে অধিক লাভের আশায় দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে এবারও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে তামাক চাষ করেছেন চাষিরা। সরকারের কঠোর নীতি এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রচারনা থাকা সত্ত্বেও অধিক লাভের বিকল্প ফসলের অভাবে চাষিরা তামাকের জালে জড়িয়ে পড়ছেন।
সরেজমিনে উপজেলার তিল্লি, বরাইদ ও দড়গ্রামের ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠ পরিদর্শনে দেখা যায়, তামাক আর তামাক। দুপুর হলেই ছোট ছোট গামলা নিয়ে সারি সারি লাইন ধরে শিশু, কিশোর, যুবকসহ বৃদ্ধরাও হাতে পাচন নিয়ে একের পর এক রোপন করে চলছেন বিষাক্ত তামাকের চারা। কেউ কেউ তামাকের চারা রোপন করার জন্য জমি তৈরী, লাঙন দিয়ে কেল টানায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ কারণে তাদের হৃদরোগ, স্ট্রোক, এলার্জি, শ্বাসতন্ত্রের মতো দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকলেও অধিক লাভের আশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিবারসহ শ্রমিক নিয়ে তামাকের মাঠে কাজ করছেন তারা। তাদের অভিযোগ উচ্চমূল্যে সার, বীজ, কিটনাশক, শ্রমিক মূল্যসহ অন্যান্য খরচ বেশি। ফলে ধান, গম, ভুট্টা যা-ই রোপন করি না কেনো তার বাজার মূল্য কম হওয়ায় ফলন ভাল হলেও লোকসান গুনতে হয়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর চলতি মৌসুমে উপজেলায় বিভিন্ন জাতের ধান আবাদ হয়েছিল পাঁচ হাজার ৩৪৮ হেক্টর, ফুলকপি-বাধাকপিসহ বিভিন্ন সবজি এক হাজার ২৩০ হেক্টর, তেল জাতীয় ফসল দুই হাজার ৮৮৫ হেক্টর, ভুট্টা চার হাজার ৯১৫ হেক্টর এবং অন্যা ১০৪ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ হয়েছিল ও বিষ বৃক্ষ তামাক আবাদ হয়েছিল ১২০ হেক্টর জমিতে। তবে অতি লাভের আশায় এবার তামাক চাষের জমির পরিমাণ কিছু হলেও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তারা।
কৃষকরা জানান, তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রতি ১০০ শতাংশ জমি জন্য পাঁচ হাজার টাকার বিনাসুদে লোন দেন। আবাদের জন্য এওবি সার, পলিথিনসহ চাষিদের নিরাপত্তার জন্য কিছু ব্যবহারযোগ্য সারঞ্জম দেন। সে সাথে সবসময় দেখাশোনা ও পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকেন ওই প্রতিনিধিরা। শুধু তাই নয় তামাকপাতা প্রক্রিয়াজাত করে শোকানো হলে ন্যায্য দাম নিশ্চিত করে চাষিদের নগদ টাকা দিয়ে দেন। অন্যান্য ফসল বিক্রি করতে হাটে হাটে ঘুরতে হয়, দাম নিয়ে নানা শঙ্কায় পড়তে হয়। ঘরে মজুত করতে গেলেও পোকায় নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু তামাক বিক্রি করতে কোনো ভোগান্তি পোহাতে হয় না, দাম বা বিক্রি নিয়ে কোনো সিন্ডিকেটের আওতায় পড়তে হয় না। এজন্য তামাকই এসব এলাকার চাষিদের ভরসা।
তিল্লি ইউনিয়নের তসবিডাঙা এলাকার সাইদুর রহমান বলেন, ‘ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে খরচের তুলনায় লাভ খুবই কম। অনেক সময় লোকসান গুনতে হয়। গত বছর প্রায় দুই বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছিলাম। অন্যান্য জমিতে সবজি আবাদ করে লোকসান গুনতে হয়েছে। তাই এবার প্রায় ছয় বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। তামাক চাষে যেমন খরচ তেমন লাভ। তাই এবার গত বারের থেকে বেশি জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে। বিষ বৃক্ষ তামাকই আমাদের এখন ভরসা। সরকার যদি ধান, চাল, পাট, ভুট্টাসহ অন্যা ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করে, সার, বীজ, কিটনাশকের মূল্য কমিয়ে দেয় তাহলে তামাক বাদে অন্যান্য ফসল রোপন করতে চাষিরা আবার আগ্রহী হবে।’
জমি প্রস্তুত কালে বরাইদ ইউনিয়নের আগ সাভার এলাকার চাষি মো: রমজান আলী বলেন, ‘গত বছর যতটুকু জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছিলাম এবার সে আবাদ কমিয়ে ৩০ বিঘা জমিতে তামাকের আবাদ করবো। অনেকে প্রতি ডিসিমল জমি ছয় শত টাকা হারে বছর চুক্তিতে লিজ নিয়ে ভুট্টা রোপন করলে দেখা যায় তার প্রতি ডিসিমলে আরো ছয় শত টাকা খরচ পরে যায়। প্রতি ডিসিমলে ভুট্টা যা হয় বিক্রি করলে তাতে লোকসান গুনতে হয়। বড় আবাদেই যদি এমন লোকসান হয় তাহলে চাষিরা বাচঁবে কিভাবে? পরিবার পরিজনের খরচ চলবে কিভাবে? তাই তামাকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি জানার পরেও পেটের দায়ে অধিক লাভের আশায় তামাক চাষ করছে। অধিক লাভে বিকল্প ফসলের আবাদ বের করতে হবে নয় তো কৃষিতে ব্যবহারের প্রয়োজনীয় পণ্যে ও সেবার মূল্য কমিয়ে ফসলের ন্যায্য মুল্য নির্ধারণ করলে তামাকের আবাদ কমতে পারে।’
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি তামাক কোম্পানির সাটুরিয়ার এক প্রতিনিধি জানান, চাষিরা নিজে থেকেই তামাক চাষে আগ্রহী হলেই তাকে লাইসেন্স দেয়া হয়। এরপর বীজ, বিনাসুদে ঋণ ও সারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহসহ বিনামুল্যে সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়। চাষিদের খরচের হিসাব করে তামাকের দাম নির্ধারণ করা হয়। তামাক ক্রয় করে চাষিদের নগদ টাকা দেয়ার সময় কোম্পানির থেকে বিতরণকৃত জিনিসের দাম এবং লোনের টাকা কর্তন করে বুঝিয়ে দেয়া হয়। সে সাথে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে চাষিদের বিভিন্ন ভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়।
এ বিষয়ে সাটুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা: তানিয়া তাবাসসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘তামাকের আবাদ কমিয়ে আনার জন্য চাষিদের গম, সরিষাসহ বিভিন্ন জাতের ফসল ও সবজি আবাদ করার জন্য প্রণোদনা ও কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে চাষিদের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেয়া অব্যহত আছে।’
এ ছাড়াও বিশেষ করে বরাইদ ইউনিয়নে যে সকল চাষিরা তামাকের আবাদের উপর নির্ভশীল তাদের মধ্যে থেকে ১৫ জন চাষিদের এক বিঘা করে জমিতে গম রোপনের জন্য শিঘ্রই প্রণোদনা দেয়া হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।



