স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে কটূক্তি এবং লোকজন দিয়ে রনিকে মারধর করার ক্ষোভে অলি মিয়াকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ আট টুকরো করা হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডটি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে আসামিরা মাথার অংশ অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখে। হত্যার দিন আসামিরা লাশ বাইরে ফেলার জন্য কোনো সুযোগ পায়নি। পরে লাশ পচে গন্ধ বের হলে পলিথিনে মোড়ানো লাশ ট্রাভেল ব্যাগে করে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায়।
রোববার (৯ আগস্ট) দুপুরে র্যাব-১-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) সালমান নূর আলম সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, আসামিদের স্বীকারোক্তিতে গাজীপুরের টঙ্গীতে ট্রাভেল ব্যাগে পলিথিনে মোড়ানো পরিবহন হেলপার অলি মিয়াকে (৩৫) হত্যার পর মাথাবিহীন আট টুকরো লাশের রহস্য উন্মোচন এবং ক্লুলেস হত্যার প্রধান আসামিসহ তিনজনকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
তারা হলেন— নরসিংদী সদর উপজেলার করিমপুর গ্রামের আব্দুল মোতালেবের ছেলে আপেল মাহমুদ সাদেক (৪২), একই গ্রামের (১ নম্বর ওয়ার্ডের মোতালেব মিয়ার বাড়ি) মজনু মিয়ার ছেলে সাজ্জাদ হোসেন রনি (২৫) এবং আপেল মাহমুদ সাদেকের স্ত্রী শাওন বেগম (৩২)।
এ ঘটনায় নিহত অলি মিয়া নরসিংদী সদর উপজেলার করিমপুর (শুক্কুর আলী মাষ্টারের বাড়ি) গ্রামের মৃত সুরুজ মিয়ার ছেলে।
সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সালমান নূর আলম নিহতের স্ত্রী শাহানা আক্তারের বরাত দিয়ে জানান, হত্যাকাণ্ডটি পূর্ব পরিকল্পিত। লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে আসামিরা মাথার অংশ অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখে। সোমবার (৪ আগস্ট) থেকে বুধবার (৬ আগস্ট) পর্যন্ত অলি মিয়ার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলে নিহত ভিকটিম অলি মিয়া রিসিভ করেননি। আবার বুধবার (৬ আগস্ট) দুপুর ২টার দিকে কল দিলে অলি মিয়ার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। পরে শুক্রবার (৮ আগস্ট) অলি মিয়ার নিহতের খবর পান তার স্ত্রী। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী শাহানা আক্তার (২৯) টঙ্গী পূর্ব থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের আসামিদের গ্রেফতারের জন্য র্যাব-১ বিষয়টি আমলে নিয়ে মূল পরিকল্পনাকারীকে ধরার জন্য ছায়া-তদন্ত শুরু করে।
শনিবার (৯ আগস্ট) র্যাব-১-এর অভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী আসামি আপেল মাহমুদ সাদেক, সাজ্জাদ হোসেন রনি এবং শাওন বেগম চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর গ্রামে অবস্থান করছে। পরে র্যাব-১ ও র্যাব-৭-এর যৌথ আভিযানে এদিন দুপুর আড়াইটায় আসামিদেরকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রধান পরিকল্পনাকারী আপেল মাহমুদ সাদেক পরিবহন হেলপার অলি মিয়াকে হত্যার কথা স্বীকার করে। তার নামে ঢাকা রেলওয়ে থানায় একটি মামলা রয়েছে।
ভিকটিম অলি মিয়া প্রধান আসামি আপেল মাহমুদ সাদেকের স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেন এবং অপর আসামি সাজ্জাদ হোসেন রনিকে গত ২/৩ বছর আগে লোকজন দিয়ে মারধর করায় অলি মিয়া। অলি মিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের ক্ষোভে আসামি আপেল মাহমুদ ও রনি পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ভিকটিম অলি মিয়াকে হত্যা করে। আসামিরা আগে একাধিকবার অলি মিয়াকে ট্রেনের নিচে চাপা দেয়ার জন্য রেললাইনে নিয়ে যায়। বুধবার (৬ আগস্ট) হত্যাকাণ্ডের দিন সকাল সাড়ে ৫টার দিকে তারা অলিকে হত্যার জন্য তাকে না জানিয়ে রেললাইনের উপরে নিয়ে যায়। ওই সময় ট্রেন না আসায় তারা তিনজন (অলি, আপেল, রনি) আপেলের বাসায় চলে আসে। একই দিনে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা তিনজন একসাথে সকালের নাস্তা করে। পরে আপেলের স্ত্রী রান্নাঘরে থাকা অবস্থায় তারা (আপেল ও রনি) পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের রুমের দরজা বন্ধ করে অলি মিয়াকে বিছানায় ফেলে দড়ি ও বেল্ট দিয়ে পা বেঁধে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে তারা ভিকটিমের লাশ টয়লেটের ভিতর রেখে দেয় এবং এদিন সন্ধ্যার দিকে বাজার থেকে ছুরি, স্কসটেপ, কালো ব্যাগ নিয়ে এসে রাত ১২টার দিকে টয়লেটের ভিতরে লাশ রেখে আসামিরা বিভিন্ন অংশে টুকরো করে এবং কালো পলিথিনের ভিতরে প্যাকেট করে টয়লেটের সানসেটে ঢুকিয়ে রাখে। পুরো ঘটনাটি আপেলের স্ত্রী শাওন বারান্দায় বসে পাহারা দেয়।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) আসামিরা লাশ বাইরে ফেলার জন্য কোনো সুযোগ পায়নি। পরে লাশ পচে গন্ধ বের হলে শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল ৬টায় আসামিরা পলিথিনে মোড়ানো লাশ ট্রাভেল ব্যাগে করে অটোরিকশাযোগে বাসা থেকে টঙ্গী স্টেশন রোডের হাজী বিরিয়ানি হাউজ ও নান্না বিরিয়ানি হাউজের সামনে ফেলে রেখে চলে যায়।
উল্লেখ্য, শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গাজীপুরের টঙ্গী পূর্ব থানাধীন টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের স্টেশন রোড (মাছিমপুর এলাকায়) হাজী বিরিয়ানি হাউজ ও নান্না বিরিয়ানি হাউজের সামনে স্থানীয় লোকজন দুটি ট্রাভেল ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখে। পড়ে থাকা ব্যাগ থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ট্রাভেল ব্যাগ খুলে ভিতরে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় যুবকের অর্ধগলিত ও মাথাবিহীন আট খণ্ড লাশ দেখতে পায়। পরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় নিহত ব্যক্তির বিস্তারিত পরিচয় শনাক্ত করা হয়।