নীতিমালার ক্ষতিপূরণ পেলেও তা নগন্য

২৫ বছরে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে ৪২৫ জন

‘২০১১ সালে নীতিমালা করে সুন্দরবনে যে কোনো প্রাণীর আক্রমণে আহত, নিহত বা ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সরকার সহযোগিতা শুরু করে। তবে এর অন্যতম শর্ত বৈধ পাসপার্মিট নিয়ে নিয়ম মেনে বনে প্রবেশ করতে হবে।’

রবিউল ইসলাম, বাগেরহাট

Location :

Bagerhat
২৫ বছরে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে ৪২৫ জন
২৫ বছরে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে ৪২৫ জন |নয়া দিগন্ত

সুন্দরবনে গত ২৫ বছরে (২০০১-২০২৫) বাঘের আক্রমণে ৪২৫ বনজীবী মারা গেছেন। এই সময়ে আহত হয়েছেন আরো ৯৫ জন। তবে এর বাইরেও হতাহতের একটা বড় সংখ্যা রয়েছে বন বিভাগের তালিকায় যার হিসেব আসেনি। ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নীতিমালা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সুন্দরবনের দুই বিভাগ (পূর্ব ও পশ্চিম) বন বিভাগ ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। বন বিভাগ সূত্র অনুযায়ী এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বন্য প্রাণি আইনের মানুষের জান-মালের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা অনুযায়ী, বন্য প্রাণির আক্রমণে কেউ মারা গেলে এক লাখ, আহত হলে ৫০ হাজার এবং বাড়ি ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হলে ২৫ হাজার টাকা দেয়ার কথা রয়েছে।

বন সংলগ্ন এলাকার বনজীবীরা বলছেন, বাঘের আক্রমণে আহত ও নিহতদের পরিবারগুলো খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। নানা নিয়মকানুন আর লাল ফিতায় আটকে থাকে সরকারি সহযোগিতা। আর যে সহযোগিতা করে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আহত-নিহতের পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবনের জন্য মাসিক ভাতা দেয়ার দাবি জানান বনজীবি ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

এ বিষয়ে সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘২০১১ সালে নীতিমালা করে সুন্দরবনে যে কোনো প্রাণীর আক্রমণে আহত, নিহত বা ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সরকার সহযোগিতা শুরু করে। তবে এর অন্যতম শর্ত বৈধ পাসপার্মিট নিয়ে নিয়ম মেনে বনে প্রবেশ করতে হবে।’

এছাড়া যেসব নারীদের স্বামীরা বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন, তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিশেষ সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এই নীতিমালার আলোকে সুন্দরবনে তিনটি খাল রয়েছে যেখানে শুধু বাঘ বিধবারাই মাছ আহরণ করতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

গত আড়াই দশক আগে এক শুক্রবারে সুন্দরবনের গহীনে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার মো: আব্দুস সামাদ হাওলাদার। দুপুরে খেতে বসার আগেই বাঘের আক্রমণের মুখে পড়েন তিনি। বাঘটি গলার নিচে কামড়ে ধরে তার। জীবন-মরণ যুদ্ধের এক পর্যায়ে অন্য কাঠ সংগ্রহকারীরা এগিয়ে আসলে চলে যায় বাঘটি। তবে বেঁচে ফিরেছিলেন এতটুকুই সান্তনা নিয়ে দুই চোখ হারিয়ে দিনাতিপাত করছেন তিনি। সুন্দরবনে বিভিন্ন সময় এভাবেই বাঘের আক্রমণের শিকার হন বৈধ বা অবৈধভাবে প্রবেশকারীরা।

২০২৩ সালের পহেলা অক্টোবর সকালে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার চারদিন পর সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতলা বন থেকে শিপার হাওলাদার(২২) নামের এক জেলের দেহ বিচ্ছিন্ন মাথা ও প্যান্ট উদ্ধার করে স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের ধারণা বাঘ তাকে খেয়ে মাথা ফেলে রেখে চলে গেছে। শিপারের মৃত্যু নিয়ে তখন হইচই হলেও, বনবিভাগের অনুমতি ছাড়া মাছ ধরতে যাওয়ায় সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি শিপারের পরিবার।

শরণখোলা উপজেলার পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা শিপারের মৃত্যুতে তার পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী মোরশেদা বেগম ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে সিনথিয়ার দিন কাটছে অভাব আর অনটনে।

শুধু শিপার বা শরণখোলা উপজেলা নয়, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলার অনেক মানুষই সুন্দরবনের গিয়ে বাঘের আক্রমনে নিহত হয়েছেন।

অপরদিকে বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী পাঁচ বছরের ব্যবধানে করা দুটি জরিপের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ বাঘ বেড়েছে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে। প্রকল্পের মাধ্যমে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ, নিরাপত্তা জোরদার, অপরাধীদের ছাড় না দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে বনে বাঘ বাড়ছে বলে দাবি বন বিভাগের।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর সুরক্ষা, প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাঘের শিকার প্রাণীর সংখ্যা বাড়ানোসহ সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করতে হবে বন বিভাগকে।

বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায়। ২০২৩ সালে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট রেঞ্জের ৬৩৯টি গ্রিডে ক্যামেরা বসিয়ে আবার গণনা করা হয় । ২০২৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ১২৫টি ।

এ বিষয়ে বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম করা হয়েছে। এছাড়া খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় বনের ৭৪ কিলোমিটার এলাকা ফেন্সিং করা হচ্ছে, ইতিমধ্যে ৬০ কিলোমিটার কাজ শেষ হয়েছে।’

আগের চেয়ে বনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অপরাধীদের ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি।’

বন অপরাধে জড়িতদের কোনো ছাড় নেই। সুপেয় পানি, আবাসস্থলসহ বাঘের সুরক্ষায় নেয়া এসব উদ্যোগের ফলে বাঘ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান তিনি।

‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’ এর সমন্বয়কারী নূর আলম শেখ বলেন, ‘বন বিভাগ বাঘ বৃদ্ধির কথা বললেও এই সংখ্যা কোনোভাবেই আশানুরূপ নয়। ২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ অভিবর্তনে বলা হয় ১২ বছরের মধ্যে এর সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। সেই হিসেবে সুন্দরবনের বাঘ বৃদ্ধির সংখ্যা নগণ্য।’

বাঘের আবাসস্থল নিরাপদ নয় দাবি করে তিনি আরো বলেন, ‘একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত অপরদিকে বিষ দিয়ে অনবরত মাছ নিধন হচ্ছে। এই পানি পান করে বাঘ যেমন অসুস্থ হচ্ছে তেমনি বনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেট সুন্দরবনে সক্রিয় আছে। তারা বাঘের দেহাংশসহ বিভিন্ন প্রাণী পাচারে জড়িত।’

এদের হাত থেকে বন রক্ষা করতে না পারলে বন্যপ্রাণীসহ সুন্দরবনের সংকট দিন দিন বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।