বিক্ষোভ এড়াতে কর্তৃপক্ষ রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও সকাল থেকে দুপুর জুড়ে
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, পদত্যাগ, পদত্যাগ’ স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে সিলেটের স্কলার্সহোম স্কুল ও কলেজের শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাস।
এই কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমান আহমদ দানিয়ালের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সাথে জড়িতদের সুষ্ঠু বিচার এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের পদত্যাগের দাবিতে রোববার সকাল থেকে ক্যাম্পাসে সমবেত হতে থাকে শত শত শিক্ষার্থী ও অভিভাবক।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে তারা ক্যাম্পাস জুড়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এসময়ে বেশ কিছু অভিভাবককেও বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা যায়। সমগ্র ক্যাম্পাস এসময় আজমানের সহপাঠী ও কলেজের বিক্ষুব্ধ শত শত শিক্ষার্থীর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে। বিক্ষোভকারীরা আজমানের মৃত্যুর জন্য দায়িদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং তার মৃত্যুর সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অবিলম্বে কলেজ থেকে পদত্যাগের দাবি জানান।
এসময় তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ এবং শিক্ষকদের পদত্যাগের দাবি দাবি জানিয়ে ‘পদত্যাগ, পদত্যাগ’ সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আগামীকাল সোমবারের মধ্যে ভাইস প্রিন্সিপাল আশরাফ আহমেদ চৌধুরীসহ ছয়জন শিক্ষককে কলেজ থেকে পদত্যাগ করার আলটিমেটাম দিয়েছেন।
নয়া দিগন্তকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্কলার্সহোমের একজন অভিভাবক ফয়সল আহমদ। তিনি রোববার বিক্ষোভের সময় শিক্ষার্থীদের সাথে ছিলেন।
দু’দিন আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা রোববার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ খবর পেয়ে স্কলার্সহোম কর্তৃপক্ষ রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু বন্ধের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্ব ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এর আগে শনিবার শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল বন্ধ থাকলেও তারা যথারীতি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহ শাখার অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীর আহমেদ কাদেরী (অব.) স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে আজমানের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে রোববার স্কলার্সহোমের শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাসের সব ধরণের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়।
এদিকে, দানিয়ালের মৃত্যুর ঘটনায় রোববার স্কলার্সহোমে বিক্ষোভ করার কথা জানিয়েছিলেন আজমানের সহপাঠীরা। আজমানের এক সহপাঠী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আজমানের মৃত্যুর ঘটনায় স্কলার্সহোম কর্তৃপক্ষের দায় রয়েছে। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির সব শিক্ষার্থীর মধ্যেই ক্ষোভ বিরাজ করছে। রোববার এ ব্যাপারে ক্যাম্পাসে আমরা সমবেত হবো। আজমানের মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনের কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাব না পেলে রোববার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করার ব্যাপারেও তারা জানিয়েছিল।
গত বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে স্কলার্সহোমের শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাসের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমান আহমেদ দানিয়ালের (১৯) লাশ নগরের সুবিদবাজার নুরানি আবাসিক এলাকার নিজ বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় পুলিশ। এ ব্যাপারে অধিকতর তদন্ত চলছে বলে এসএমপি পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) কলেজ অধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘স্কলার্সহোমের দ্বাদশ শ্র্রেণির শিক্ষার্থী আজমান আহমদ দানিয়ালের আকস্মিক মৃত্যুতে স্কলার্সহোম পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। এ জন্য আগামী ২১ সেপ্টেম্বর (রোববার) স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাসের সব ধরণের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম (শ্রেণি কার্যক্রম, পরীক্ষা, ব্যবহারিক পরীক্ষা ইত্যাদি) বন্ধ থাকবে।’
আজমানের মত্যুর খবরে ছড়িয়ে পরার পর থেকেই স্কলার্সহোম কর্তৃপক্ষের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তার সহপাঠী ও ওই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। এমনকি অনেক সাবেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও স্কলার্সহোমের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাকেদের সাথে খারাপ আচরণ, পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক না থাকা, শিক্ষার্থী খারাপ করলে ছাড়পত্র দিয়ে বের করে দেয়ার অভিযোগ তুলেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে আজমানের দাফন সম্পন্ন হয়। আজমানের মা ও সহপাঠীদের অভিযোগ, এইচএসসি (২০২৬) এর প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করায় আজমানের সাথে খারাপ ব্যবহার, অভিভাবকদের ডেকে এনে অপমান ও কলেজ থেকে ছাড়পত্র দেয়ায় আত্মহত্যা করেন আজমান।
ছেলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর আজমানের মায়ের বুকফাটা কান্না আর আহাজারির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। আজমানের মা ভিডিওতে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় স্কলার্সহোমে ডেকে নিয়ে মা-বাবাকে অপমান করার বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন, ছেলেকে পরীক্ষার সুযোগ দিতে অনুরোধ করায় ছেলের সামনে আমাদেরকে (মা-বাবাকে) ‘দুর দুর’ করে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
ছেলের মৃত্যুর জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে তিনি ভিডিওতে বলেছেন, তার নামাজি ও নফল রোজাদার ছেলের কোনো দোষ নেই। ভিডিওতে দেখা যায়, আক্ষেপ আর বুকফাটা কান্নায় তিনি ভেঙে পড়েছেন। বলছেন, ‘আর পড়ার দরকার নেই, সব পড়ার বই স্কলার্সহোমে নিয়ে ফেলে দাও। পড়াশোনা করার আর কোনো দরকার নেই।’
আজমানের মায়ের এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায় ১ লাখের মতো শেয়ার হয়েছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে স্কলার্সহোম’র শাহী ঈদগাহ শাখার অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীর আহমেদ কাদেরী (অব.) গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৩/৪ দিন আগে আজমানের বাবাকে কলেজে ডেকে এনে এসব তথ্য জানানো হয়। এবং বলা হয়, এভাবে সে টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে পারবে না। আপনি চাইলে তাকে অন্য কলেজে নিয়ে যেতে পারেন। কোনো খারাপ ববহার করা হয়নি।’
প্রি-টেস্টে অকৃতকার্য হলে ছাড়পত্র প্রদান করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে ছাড়পত্র দেই না। সে এখতিয়ারও আমাদের নেই। এটি শিক্ষাবোর্ড অনুমোদন করে। তবে খারাপ ছাত্রদের অভিভাবদের আমরা অনুরোধ করি- যেহেতু এখানে সে ভালো করতে পারছে না, তাই আপনারা চাইলে অন্য কলেজে নিয়ে যেতে পারেন।’
শিক্ষার্থীরা খারাপ ফল করলে অভিভাবদের ডেকে এনে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুনীর আহমেদ কাদেরী বলেন, ‘আমরা কারো সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করি না। তবে বড় ক্লাসের অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খারাপ করলে বাসায় গিয়ে জানায় না। তাই আমরা অভিভাবদের ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের ফলাফল জানাই। তার প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে অনুরোধ করি। শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্যই এসব করি।’
স্কলার্সহোমের শিক্ষার্থী আজমানের এই মৃত্যুর ঘটনা ক’দিন থেকেই সিলেটে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একজন কিশোর ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা সিলেটে এবং দেশে বিদেশে হৃদয় বিদারক হিসেবে অভিহিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজমানের মৃত্যুর জন্য দায়িদের বিচারের দাবি উঠেছে। স্কলার্সহোমের নানা অনিয়ম ও নেতিবাচক ভূমিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উঠে আসছে।
আওয়ামী লীগের পলাতক সাবেক এমপি, পূবালী ব্যাংকের একসময়ের প্রভাবশালী পরিচালক ও দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি হাফিজ আহমদ মজুমদারের মালিকাধীন ‘হাফিজ মজুমদার ট্রাস্ট’ এর মালিকানায় পরিচালিত স্কলার্সহোমের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ রয়েছে। শুধু টাকা আয়ের এক বড় উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয় বলেও অনেকের অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের নানাভাবে নির্যাতন ও হয়রানি এবং অভিভাবকদের অপমান করার বহু ঘটনা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে সিলেট শহরে এই প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ৬টি শাখা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এর পরিচালনার সাথে জড়িত রয়েছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লোকমান আহমেদ চৌধুরী।