জুলাই বিপ্লবে হাতিয়া দ্বীপের দুই শহীদ মাহমুদুল হাসান রিজভী ও মো: রিটন উদ্দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তারা শহীদ হয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগে হাতিয়াবাসী গর্বিত। যুগে যুগে স্বৈরাচার, জুলুমবাজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে তাদের এ ত্যাগ দ্বীপবাসীকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
জাতীয় আন্দোলনে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রেরণা যোগাতে তাদের সম্মান দিতে হবে। দ্বীপের বীর শহিদদের সম্মান জানালেই বীরের জন্ম হবে।
শহীদ মাহমুদুল হাসান রিজভী
জুলাই আন্দোলনে বীর শহীদ মাহমুদুল হাসান রিজভী লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেক্টট্রিক্যাল ট্রেডের অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি হাতিয়া উপজেলার চরকিং ইউনিয়নের মো: জামাল উদ্দিনের ছেলে। পরিবারের বড় ছেলেকে নিয়ে মা-বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল।
রিজভী পরিবারের অগোচরে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় আবু সাঈদ ও আরো ছয় জনের নিহত হওয়ার খবরে ছাত্র-জনতার মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পরিচিত সহপাঠীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে সে তার কয়েকজন সহপাঠী নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। মা ফরিদা ইয়াসমিন খবর পেয়ে ফোন করে রিজভীকে সাবধানে থাকতে বললেও রিজভী মাকে আশ্বস্ত করেছিলেন সে কোনো আন্দোলনে যাচ্ছে না।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় দু’ছাত্র গুলিতে নিহত হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকার উত্তরা পূর্ব থানার সামনে রাস্তায় ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, গুলি ছোঁড়ে। এতে রিজভীর মাথার খুলি উড়ে যায় এবং মাথার অংশ রাস্তায় পড়ে থাকে। ফ্লাইওভারের ওপর থেকে তাকে গুলি করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। ওই সময় গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১০টার দিকে রিজভী মারা যান।
ওই সময়ের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তার লাশ গ্রামের (নিজ) বাড়িতে নেয়া যায়নি। হাতিয়া উত্তরপাশে নদীর ওপারে হরণী ইউনিয়নের পূর্ব মোহাম্মদপুর গ্রামে নানার বাড়ির কবরস্থানে তাকে গোপনে দাপন করা হয়। এ ঘটনায় ন্যায়বিচারের আশায় রিজভীর মা উত্তরা থানায় একটি মামলা করেছেন।
এই শহীদদের স্মরণে এখনো দ্বীপের কোথাও স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে হাতিয়া দ্বীপ সরকারি কলেজের নবনির্মিত দু’টি আবাসিক হলের অন্তত একটির নাম শহীদ রিজভ-রিটন হল নামকরণ করা হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ছাত্রছাত্রীদের দেশপ্রেম ও দেশ মাতৃকায় কতটুকু কর্তব্যবোধ থাকা উচিত তার দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন ফ্যাসিস্ট পতনের আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে।
ভাইবোনদের মুখে হাসি ফোটাতে মিছিলে গিয়েছিলেন শহীদ রিটন
আকিজ কোম্পানির যাত্রাবাড়ি জোনে চাকরির সুবাদে অফিসে থাকতেন শহীদ মো: রিটন উদ্দিন। তিনি হাতিয়া উপজেলার নলচিরা ইউনিয়নের লামছড়ি গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। তার ছোট ভাই আরিফ উদ্দিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এনথ্রোপলজিতে ও ছোট বোন মিশু বেগম ইডেন কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। তারা সাবলেটে থাকেন শনির আখড়ায়। পারিবারিক অসচ্ছলতার মধ্যেও কঠোর পরিশ্রমে ছোট ভাইবোনকে টিউশনি করে ঢাকায় পড়তে হতো কোটা ও বৈষম্যমুক্ত উন্নত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে।
শহীদ রিটনের ছোট ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় নেতা আরিফ উদ্দিন বলেন, ৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে নেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় বের হই। আমার সাথে বড় ভাই রিটনও রাস্তায় বের হয়ে মিছিলে অংশ নেন। শনির আখড়ায় কিছু সেনাবাহিনী আমাদেরকে বাধা দেয়। কিন্তু আমরা সেই বাধা অতিক্রম করে প্রায় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে চলে আসি।
এ সময় দেখতে পাই থানার সামনে ১০০ থেকে ২০০ পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি ভালো না দেখে রাস্তার লেন পরিবর্তন করে উলটা পাশে চলে যাই। পেছনে ফিরে ভাইকে ডাকতে থাকি, হাত তুলে ডাকলেও ভাই বুঝতে পারেনি। খণ্ড মিছিলসহ ভাই আরো অনেকের সাথে থানার সামনে পুলিশকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে। তখন বেলা প্রায় ১২টা। পুলিশ অ্যাকশান ছবির মতো ওপেন ফায়ার করে।
আমি রাস্তার উলটা পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কান্না করি। আমার ভাই গলাকাটা মুরগি মতো মাটিতে দাপাচ্ছে আর চিৎকার করছে। আমি তখন পাশের গলিতে দৃশ্যটা দেখা ছাড়া নিরুপায় ছিলাম। প্রায় ৪০ মিনিট পরে পুলিশ থানায় ঢোকার পর ভাইকেসহ আরো অনেককে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যায়। তখনো ভাই জীবিত ছিল। ডাক্তার তিন ব্যাগ রক্ত লাগবে বলেছিল। রক্ত সংগ্রহ করে দু’ব্যাগ নিতে পারলেও তৃতীয় ব্যাগ নিতে পারেনি। ভাই পরপারে চলে যায় বিকেল পৌনে ৪টার দিকে।
শহীদ মো: রিটন উদ্দিনের স্ত্রী ও দু’ছেলে একজন মেয়ে রয়েছে। তার বাবা আবুল কালাম হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে আছেন। রিটনের আয়ের উপরে বাবা মা ও পরিবারের দিন চলত। বর্তমানে সরকারি অনুদানের মাসিক যে ভাতা আসে তা দিয়ে পরিবার চালানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানান ছোট ভাই আরিফ।