ভূমিকম্পে গাজীপুরে হাসপাতালসহ বহু ভবনে ফাটল, হেলে পড়েছেও অনেক

গাজীপুর প্রেসক্লাব, শহীদ তাজউদ্দিন হাসপাতালের পুরাতন ভবনসহ বহু ভবনের ফাটল ধরেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বহু ভবন হেলে যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।

মোহাম্মদ আলী ঝিলন, গাজীপুর

Location :

Gazipur
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আহতদের স্বজনদের ভিড়
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আহতদের স্বজনদের ভিড় |নয়া দিগন্ত

শুক্রবারের ভূমিকম্পে কারখানা ও পোশক শ্রমিকসহ গাজীপুরে অর্ধ-সহস্রাধিক জনতা আহত হয়েছে। আহতদের বড় একটি অংশ তৈরী পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক। নিরাপত্তা গেট বন্ধ থাকা এবং আতঙ্কিত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক জীবন বাঁচাতে গেট দিয়ে একসাথে বের হতে গিয়ে চাপে পড়ে ও পদদলিত হয়ে হতাহত বেশি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকাসহ বড় হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে, গাজীপুর প্রেসক্লাব, শহীদ তাজউদ্দিন হাসপাতালের পুরাতন ভবনসহ বহু ভবনের ফাটল ধরেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বহু ভবন হেলে যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। ভূমিকম্পে জেলা ও মহানগর এলাকার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ ও জরুরি সেবার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জরুরি সেবা ও তথ্য সেল খোলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর পরীক্ষার-নিরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ী এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর স্থানীয় ডেনিমেক পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা হুড়োহুড়ি করে নামার সময় তিন শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিকেরা। আহত অনেক শ্রমিকের স্বজনেরা তাদেরকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল এবং ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়।

শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক সাইয়িদা আফরোজ ইমা জানান, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় ম্যাস হিস্টিরিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে কারো শরীরে বড় ধরনের আঘাত নেই।

শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) বিজন মালাকার জানান, ডেনিমেক পোশাক কারখানার ৮৩ জন শ্রমিক হাসপাতালে রেজিস্ট্রার্ড হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৩ জনকে এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে, দুইজনকে ঢাকার পঙ্গু, ছয়জনকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ এবং ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালে বেড স্বল্পতার কারণে স্বজনেরা আহত শ্রমিকদেরকে এ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

এদিকে, ডেনিমেক পোশাক কারখানায় শ্রমিক আহতের খবর পেয়ে বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং গাজীপুর-৩ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক ডা: এস এম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু নেতাকর্মীদেরকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হন। তিনি আহত শ্রমিকদের সাথে কথা বলেন, তাদের খোঁজখবর নেন ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

অপরদিকে ভূমিকম্পের সময় টঙ্গীর বিসিকসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার কারখানাগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। টঙ্গীর স্টেশন রোডে ছয়তলা ভবন ১২ তলা ভবনের উপর হেলে পড়েছে। ভূমিকম্পে টঙ্গীর বহু ভবনে ফাটল ও স্থানচ্যুতির ঘটনাও ঘটেছে। একটি কারখানায় দৌড়াদৌড়ি, হুড়োহুড়ি শুরু হলে অনেক শ্রমিক দিগ্বিগিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। এ সময় কারখানার জরুরি নিরাপত্তা গেট বন্ধ থাকায় প্রবল চাপ সৃষ্টি হয় ৯ তলা ভবনের সিঁড়িতে। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়ে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ পদদলিত হয়ে আহত হন। কারখানার ৯ তলা ভবনের প্রায় সব কর্মী একই সময়ে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করলে মানবজটের সৃষ্টি হয়। দ্রুত নিচে নামতে গিয়ে একে অপরের উপর পড়ে আহত হন।

ঘটনার পর কারখানা কর্তৃপক্ষের কেউ গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, জরুরি গেট বন্ধ থাকা এবং যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিলে আহতের সংখ্যা অনেক কম হতো।

ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি জানতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ছুটে যান গাজীপুর-৬ আসনের জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী ড. হাফিজুর রহমান। তিনি আহতদের চিকিৎসা সেবা, চিকিৎসকদের প্রস্তুতি ও হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনা দেখেন।

তিনি বলেন, ‘যেকোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের প্রথম দায়িত্ব। ভয় নয়, আমরা সবাই মিলে সহযোগিতা ও সচেতনতার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি সামাল দেবো।’

এদিকে, গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা: মো: মামুনুর রহমান জানান, জেলায় মোট আহত হয়েছেন ৪০০ জন। এর মধ্যে ভর্তি রয়েছেন ৮৬ জন, ছোটখাটো আঘাত পেয়েছেন ৯৭ জন, টঙ্গীতে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯০ জন এবং গুরুতর ৪৩ জনকে রেফার করা হয়েছে। এছাড়া শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া ও গাজীপুর সদরের বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা অব্যাহত রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মামুন জানান, গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় হাসান তারভিন গার্মেন্টসে কয়েকজন শ্রমিক আহত হয়েছেন, শ্রীপুরের ডেনিমেক গার্মেন্টসে আরো ৬৭ জন আহত হয়েছেন। মহানগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড চপুলিয়া এলাকায় চারতলা ভবন হেলে পড়েছে। এছাড়া গাজীপুর প্রেসক্লাব ভবনেও ফাটল দেখা দিয়েছে।

শহীদ তাজউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো: আমিনুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে মোট ৮২ জন আহত রোগী এসেছেন, ভর্তি রয়েছেন ৫৫ জন, যার মধ্যে ৪৯ জন নারী, পাঁচজন পুরুষ ও এক শিশু রয়েছে। তাদের সবাই মূলত দৌড়াদৌড়ি ও আতঙ্কে পড়ে আহত হয়েছেন।

তিনি আরো জানান, হাসপাতালের পুরাতন ওয়ার্ড ভবনের একাংশে ফাটল দেখা গেছে।

সিটি করপোরেশনের প্রশাসক সরফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নগরবাসীর সুরক্ষা ও সেবা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ভূমিকম্পের পরপরই ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে।

সিটি করপোরেশন সচিব মো: আমিন আল পারভেজ জানান, বিদ্যুৎ, পানি, স্যানিটেশন ভবনে ফাটলসহ যেকোনো অভিযোগে আমরা এখনই রেসপন্স করছি।

গাজীপুরের এডিসি জেনারেল মুতাসেম বিল্লাহ জানান, ভূমিকম্প-পরবর্তী তথ্য সংগ্রহ ও নাগরিক সেবা প্রদানে জেলা প্রশাসনও নিজের জরুরি কন্ট্রোল রুম চালু করেছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলম হোসেন বলেন, জরুরি সেবা নিশ্চিতের জন্য সব উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, স্বাস্থ্য বিভাগ একযোগে কাজ করছে। হালনাগাদ তথ্য নিয়মিত জানানো হবে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো: ইসরাইল হাওলাদার জানান, নগরের প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। আহতদের হাসপাতালে নেয়ার কাজও পুলিশ করছে।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো: যাবের সাদেক বলেন, জেলার কোথাও বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। কিছু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আতঙ্কিত হয়ে অনেকে আহত হয়েছেন। উপজেলার সব স্পটে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জরুরি সহায়তা দেয়া হচ্ছে। নগরজুড়ে ভবনে ফাটল, হেলেপড়া কাঠামো পরীক্ষায় প্রকৌশলীরা কাজ শুরু করেছেন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস নাগরিকদের সতর্ক থাকতে এবং যেকোনো সমস্যা দেখলেই জরুরি নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছে।