দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘মুসলমানদেরকে জ্ঞান অর্জনের জেহাদ করতে হবে। তরুণদের সাহসী ভূমিকায় আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত হতে পেরেছি। এবারের বিপ্লবটা হোক জ্ঞান অর্জনের বিপ্লব। তাহলেই বিশ্বকে জয়লাভ করা যাবে।’
শনিবার (২৯ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত আইআইইউসি টেকফেস্ট-এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এসময় তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে আমাদের তরুণরা প্রমাণ করেছেন তারা জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। আল্লাহ যদি সহায় থাকেন, আমার বিশ্বাস তারা অনেক কিছু করতে পারবেন। জাতিকে ফ্যাসিবাদুমক্ত করার জন্য তরুণ সমাজকে ধন্যবাদ জানাই। এখন আমাদের দরকার জ্ঞানের বিপ্লব।
তিনি বলেন, আমরা মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। কারণ আমরা নিজেরা যেমন এই বিষয়কে গুরুত্ব দিই না, তেমনি আমাদেরও সরকারও গুরুত্ব দেয় না। সরকার একজন অর্থনীতিবিদকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। তিনি আবার অর্থ উপদেষ্টাও। এতেই বোঝা যায় সরকার এই খাতকে কতটা গুরুত্ব দেয়। আমার সন্দেহ আছে সালাউদ্দিন আহমেদ কয়দিন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মিনিস্ট্রিতে অফিস করেছেন। এমনকি তিনি এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে কিছুই করেননি। সরকারের পক্ষ থেকে তরুণদের উৎসাহ দিতে কোনো সেমিনার, প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেননি। আমার মনে হয় আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদের মধ্যে যাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হবে তিনি হয়তো ভাববেন তাকে সবচেয়ে কম গুরুত্বহীন মন্ত্রণালয় দেয়া হয়েছে। অথচ সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের ইতিহাস তুলে ধরে প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান বলেন, বিশ্বে এই মুহুর্তে ২০০ কোটি মুসলমান আছে, কিন্তু সর্বত্র মুসলমানরা আজ নির্যাতিত, অত্যাচারিত। একসময় মুসলমানদের স্বর্ণ যুগ ছিল। সেটাকে আমরা বলি ইসলামিক সিভিলাইজেশন। অস্টম শতাব্দি থেকে ১৩ শ’ শব্দাদী পর্যন্ত।
মঙ্গলরা যখন বাগদাদ আক্রমণ করল এবং বায়তুল হিকমাহ পুড়িয়ে দিলো, জ্ঞানের যতো ভান্ডার আছে সব ধ্বংস করে দিলো। তারপর থেকে ইসলামের যেই স্বর্ণ যুগ সেটার সমাপ্তি হয়েছে। সেই স্বর্ণ যুগের কয়েকজন মনীষীররা হলেন, আল খোয়ারিজমি নবম শতাব্দির। যিনি আলজেবরার আবিস্কারক ছিলেন। জাবির ইবনে হাইয়ান একই সময়ের মানুষ। তিনি ফাদার অব কেমিস্ট্রি ছিলেন। তিনি এক্সেপেরিমেন্ট করতেন। অর্গানিক সাবন্টেন্স থেকে। উদ্ভিদ থেকে এমোনিয়াম নাইট্রেট বের করার ফর্মুলা বের করেছিলেন সেই নবম শতাব্দিতে। আব্বাস ইবনে ফিরনাস ম্যাগনিফাইং গ্লাস আবিস্কার করেছিলেন। কোন রকম ইঞ্জিন ছাড়া ফ্লাইয়িং কনসেপ্ট বের করেছিলেন সেইসময়। এভাবে আল মাসউদি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, আল ইদ্রিসিসহ অনেক মুসলমান মনীষী আছেন। মাত্র দুইশো বছরের ইতিহাসে ১০ জন মনীষীর নাম পাওয়া গেলে পুরো ইতিহাস ঘাঁটলে ১০০ জন মুসলমান বিজ্ঞানীর নাম পাওয়া যাবে।
অথচ আমরা বিজ্ঞানের কথা বলতে গেলে এখন এরিস্টটল, আইনস্টাইন, নিউটন, লিও টলস্টয়দের কথা বলি। কিন্তু মুসলামন মনীষীদের অবদান চিকিৎসা, শিক্ষা, রসায়ন, সবক্ষেত্রে আছে। এই ইসলামিক সিভিলাইজেশন তরবারি ও ক্ষমতা দিয়ে হয়নি, হয়েছে জ্ঞান আর বিজ্ঞান দিয়ে। কতো বড় সাম্রাজ্য ছিল সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো তারা কি করেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে থেকে পিছিয়ে পড়াতে মুসলমানরা আজ নির্যাতিত হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। তাদের সামরিক শক্তি কম। তবুও ২০২৫ সালে ফিলিস্তিনের একজন মুসলমান নাগরিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে কেমিস্ট্রিতে। এই নিয়ে চারজন মুসলমান কেমিস্ট্রিতে নোবেল পেয়েছে। এজন্য আল কেমী হিসেবে খ্যাত জাবির ইবনে হাইয়াকে ধন্যবাদ। হয়তো তার কারণে মুসলমানদের মধ্যে সেই সিলসিলা অব্যাহত আছে।
তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকফেস্টে অংশগ্রহণকারী ও বিজয়ীদের অভিনন্দন। এদের হাত ধরে আবারও ইসলামি রেনেসাঁ নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই তরুণদের হাত ধরে আবারও ইসলামের গোল্ডেন এরা ফিরে আসবে। আবারও ইবনে সিনা, জাবির ইবনের হাইয়ানরা বেরিয়ে আসবে। জ্ঞানের জেহাদ করতে পারলে আমরা বিজয়ী হব এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত এই তরুণদের উপর নির্ভর করছে। জাতি আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে মানুষের মেশিনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। মেশিন মানুষকে জ্ঞানশূন্য করে দেবে। কারণ সব তথ্য যদি গুগলে পাওয়া যায় তাহলে ব্রেন ডেড হয়ে যাবে। তখন ব্রেন আর কাজ করবে না। আমি এখনও হাতের কর গুনে অঙ্ক করি। আমরা যখন বুয়েটে অঙ্ক করতাম, তখন স্লাইটবুল দিয়ে অঙ্ক করতাম। স্লাইটবুল কী আপনারা জানেন না, দেখেননি। এখন ছেলেমেয়েদের নামতা বলতে বলা হয় না। আমাদের সময় মা-বাবা, মুরুব্বিরা বিপদে ফেলতে চাইলে তারা নামতা বলতে বলতেন। কাজেই এই প্র্যাকটিসগুলো থাকা দরকার। তাহলে ব্রেন কর্মক্ষম থাকবে। মেশিন মানুষকে দিন দিন অথর্ব বানাচ্ছে। আমি মনে করি এই স্পিরিচুয়ালিটি আপনারা ব্যবহার করবেন। অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। এর আগে প্রধান অতিথি হিসেবে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে জুলাই কর্ণার উদ্বোধন করেন এবং জুলাই বিপ্লবে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়ে তৈরি প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন।
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর মোহাম্মদ আলী আজাদীর সভাপতিত্বে গেস্ট অব অনার ছিলেন বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ ইমাদুর রহমান। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন আইআইইউসি'র ট্রেজারার প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, আকিজ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের হেড অব অপারেশন মো. তৌহিদুল ইসলাম ফয়সাল, ইটিই বিভাগের চেয়ারম্যান মো. ইব্রাহীম রুপম প্রমুখ।
পুরো অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে নয়া দিগন্ত, আমার দেশ ও এখন টিভিকেও সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।



