সিলেটে সাংবাদিক তুরাবসহ ১৫ হত্যা মামলার বিচারে অগ্রগতি নেই!

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সিলেট জেলায় ১৯ জন নিহত হন। তাদের সবারই গুলিতে মৃত্যু হয়েছে।

এমজেএইচ জামিল, সিলেট ব্যুরো

Location :

Sylhet
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সিলেটে ১৫ জন শহীদ হন
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সিলেটে ১৫ জন শহীদ হন |নয়া দিগন্ত

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের এক বছরেও সিলেটের শহীদ নয়া দিগন্তের তৎকালীন সিলেট ব্যুরো প্রধান এটিএম তুরাবসহ ১৫ হত্যা মামলার তেমন অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। মামলা হলেও তদন্তে গতি না থাকায় ন্যায়বিচার নিয়ে সন্দিহান সিলেটের ১৫ শহীদের পরিবার।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সিলেট জেলায় ১৯ জন নিহত হন। তাদের সবারই গুলিতে মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫ আগস্ট নিহত পংকজ কুমারের লাশ পাওয়া গেলেও সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক শাহজাহানের লাশ এখনো পাওয়া যায়নি। এছাড়া ৫ আগস্ট গোয়াইনঘাটে দু’জনের নিহত হলেও তাদের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েছে। তবে ৫ আগস্ট পংকজ কুমার ও শাহজাহানের নাম গেজেটভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হওয়ার পথে।

গেজেটভুক্ত ১৫ জনের মধ্যে শুধু রুদ্র সেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র হলেও বাড়ি দিনাজপুরে থাকায় সেই জেলার গেজেটভুক্ত হন। ফলে সিলেটের গেজেটভুক্ত শহীদ ১৪ জন। সকলের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা হলেও এসব মামলার তেমন অগ্রগতি না থাকায় বিচার নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় তাড়া খেয়ে নগরীর একটি ছড়ার পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় শিক্ষার্থী রুদ্র সেনের। এরপর ১৯ জুলাই নগরীর কোর্ট পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে শহীদ হন জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার ফতেহপুর গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক এটিএম তুরাব।

১৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার বাড্ডায় নিহত হন সিলেট সদর জেলার কান্দিগাও ইউনিয়নের ইনাতাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ওয়াসিম। ২০ জুলাই নারায়নগঞ্জে নিহত হন বিয়ানীবাজার উপজেলার চারখাই ইউনিয়নের কাকুরা গ্রামের সোহেল আহমদ। ২ আগস্ট হবিগঞ্জ সদরে নিহত হন সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নের ঘোপাল গৌরীপুর গ্রামের মোস্তাক আহমদ। ৪ আগস্ট এক দিনে গোলাপগঞ্জে নিহত হন ছয়জন- উপজেলার পশ্চিম আমুড়া ইউনিয়নের শিলঘাট গ্রামের সানি আহমদ, লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের নিশ্চিন্ত গ্রামের নাজমুল ইসলাম, ঘোষগাঁও উত্তরের মোবারকের বাড়ির গৌছ উদ্দিন, ঢাকা দক্ষিণের পশ্চিম দত্তরাইলের মিনহাজ আহমদ, ঢাকা দক্ষিণের দক্ষিণ রায়গড়ের রজয় আহমদ ও ঢাকা দক্ষিণের বারকোট গ্রামের তাজ উদ্দিন।

৫ আগস্ট মহানগর এলাকায় নিহত হন গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ-উত্তর কানিশাইল এলাকার পাবেল আহমদ কামরুল। এছাড়া একই দিনে বিয়ানীবাজারে নিহত হন তিনজন। তারা হলেন বিয়ানীবাজার পৌরসভার নয়াগ্রামের রায়হান উদ্দিন, মোল্লাপুর নিদনপুর তারেক আহমদ ও নয়াগ্রামের ময়নুল ইসলাম।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের নিহতের ঘটনায় সিলেট জেলার দুই থানায় ১০টি এবং সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের থানায় চারটি মামলা দায়ের করা হয়।

এর মধ্যে গোলাপগঞ্জ থানায় সাতটি ও বিয়ানীবাজার থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। মেট্রো থানায় দায়ের করা চারটি মামলার মধ্যে সাংবাদিক এটিএম তুরাবের মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে এবং শিক্ষার্থী রুদ্র সেন হত্যা মামলা সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকি দু’টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।

নিহত ১৫ জনের মধ্যে বেশিভাগের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না থাকায় এসব মামলার তদন্তু ও অগ্রগতি প্রায় শূন্য। তবে গোলাপগঞ্জে দায়ের করা দু’টি হত্যা মামলার চার্জশিট আগামী মাসেই দেয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

১৪টি হত্যা মামলার মধ্যে একমাত্র সাংবাদিক এটিএম তুরাব হত্যা মামলায় এসএমপির সাবেক এডিসি সাদেক কাউসার দস্তগীর ও পুলিশ কনস্টেবল উজ্জল সিনহা কারাগারে রয়েছেন। আর কোনো মামলায় কোনো আসামি গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায়নি।

তুরাবের মামলার তদন্ত কাজ কিছুটা এগিয়ে গেলেও রুদ্র সেন হত্যা মামলা এখনো অন্ধকারে। বাকি মামলাগুলোর অবস্থাও থমকে রয়েছে।

রুদ্র সেনের মামলার বাদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালিন সমন্বয়ক হাফিজুল ইসলাম দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, রুদ্র সেন হত্যা মামলার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে শুনেছি। তবে কোনো আসামি এখনো গ্রেফতার হয়নি।

রুদ্র সেনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি ইন্সপেক্টর ইমরান আহমদ বলেন, মামলার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে তদন্তের স্বার্থে বলা যাচ্ছে না। তবে চার্জশিট দিতে আরো কিছুটা সময় লাগবে।

সাংবাদিক এটিএম তুরাব হত্যা মামলার বাদি আবুল আহসান মো: আজরফ (জাবুর) বলেন, এক বছর হয়ে গেল আমার ভাই হত্যার বিচারের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হলো। মাত্র দু’জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার অন্যতম আসামি আজবাহার আলী শেখ এখনো বহাল তবিয়তে। অন্য কোনো আসামিও গ্রেফতার নেই। এ নিয়ে আমরা হতাশ।

সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, তুরাব হত্যা মামলার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। গত ৩১ জুলাই দুই আসামি সাদেক কাউসার দস্তগীর ও উজ্জল সিনহাকে এক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। আগামী ২৩ আগস্ট তুরাব হত্যা মামলার তারিখ রয়েছে। আমরা এর মধ্যে চার্জশিট জমা দেয়ার চেষ্টা করছি।

এসএমপির মিডিয়া অফিসার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, মেট্রো এলাকার থানায় চারটি মামলার মধ্যে দু’টি মামলার একটি আইসিটি কোর্টে (ট্রাইব্যুনালে) আর আরেকটি সিআইডিতে আছে। আর বাকি দুই মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। কারণ নিহত দু’জনের সুরতহাল ও পোস্টমর্টেম না থাকায় মামলার কাজ এগিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপরও তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয়ে তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে।

সিলেট জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, সিলেট জেলায় দায়েরকৃত ১০টি মামলার মধ্যে গোলাপগঞ্জ থানার দু’টি মামলার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। আশা করছি, আগামী মাসেই দু’টির চার্জশিট দেয়া সম্ভব হবে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত কাজ নিজস্ব প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলছে।