উত্তপ্ত রাজপথে ইতিহাস রচনার প্রাক্কালে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রক্ত ঝরিয়েছেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার সাহসী সন্তান এমদাদুল হক। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন এ তরুণ ইসলামী ছাত্রশিবিরের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।
পেশায় গাড়িচালক হলেও অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাজপথে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননি। গত বছরের ২০ জুলাই সকাল ৯টার দিকে উত্তর বাড্ডার এএম জেড হাসপাতালের পাশে এক হোটেলে সহযোদ্ধা সজীবের সাথে নাশতা সেরে আন্দোলনে যোগ দেন এমদাদুল। হঠাৎই সাঁজোয়া যান ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রধারী পুলিশের দল নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলে পড়ে। শুরু হয় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। এক পর্যায়ে কাছ থেকে ছোড়া পুলিশের গুলি কপাল ভেদ করে মাথা চিরে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়।
ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন এমদাদুল। সহযোদ্ধারা হাসপাতালে নিতে গেলে মাঝপথেই তার নিথর দেহ ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়, আরো একজন ‘জুলাই শহীদ’।
ভান্ডারিয়ার উপজেলার ধাওয়া গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম এমদাদুল হকের। বাবা মো: ছোবাহান হাওলাদার ও মা ফাতিমা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে ছোট ছিলেন তিনি। অভাব-অনটনের কারণে শিক্ষাজীবন ব্যাহত হলেও মা-বাবার চিকিৎসা ও সংসার চালাতে গাড়ি চালানো শুরু করেন।
মা ফাতিমা বলেন, “আমার ছেলেটা যদি একটু ফিরে আসত! ও তো বলেছিল, ‘মা, তোমার আর খালে গিয়ে পানি আনতে হবে না। আমি মোটর কিনে দেবো।’ কিন্তু পানির মোটরের বদলে পেলাম ছেলের লাশ।”
বাবা ছোবাহান হাওলাদার ছেলের স্মৃতিতে বাকরুদ্ধ, শুধুই দীর্ঘশ্বাস।
দু’ভাই ও এক বোনের পরিবারটিতে জমিজমা, সঞ্চয় কিংবা ভরসার কোনো অবলম্বন নেই। এমদাদুল ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যু যেন পরিবারটির একমাত্র খুঁটি উপড়ে নেয়ার মতোই। সরকারি-বেসরকারি সহায়তা ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় চলছে তাদের কোনোভাবে বেঁচে থাকা। সবশেষ ঈদুল আজহায় পেয়েছেন কিছু ঈদ সামগ্রী।
এমদাদুলের গ্রামে পৌঁছালে স্থানীয় ফ্যাসিস্ট সহযোগীরা প্রকাশ্য জানাজা বন্ধের অপচেষ্টা চালায়। তবে জনরোষে তারা পিছু হটলেও দাফনে অংশগ্রহণকারীরা পরবর্তীতে নানা হুমকির মুখে পড়েন। ৯ সেপ্টেম্বর শহীদের আত্মীয় সাইফুল ইসলাম ১২১ জন নামীয় ও ১০০-২০০ জন অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ভান্ডারিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আহমদ আনোয়ার বলেন, ‘মামলাটি ঢাকার বাড্ডা থানায় হওয়ায় তদন্তের দায় তাদের। তারা গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠালে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
জুলাই বিপ্লবের প্রতিটি রক্তবিন্দু যেন শোষণ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একেকটি উচ্চারণ, একেকটি শপথ। এমদাদুল হক সেই শপথের একজন শহীদ সৈনিক। তার গল্প কেবল একজন সন্তানের ত্যাগ নয়, এটি একজন কর্মীর, একজন লড়াকুর, একজন ইতিহাস নির্মাতার অক্ষয় স্মৃতি।