স্বামী খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ‘সচিব’ আর স্ত্রী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। এই পরিচয় ব্যবহার করে সরকারি দফতরে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ যুবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। এমন অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী এক যুবক।
মামলার দুই আসামি হলেন খাদ্য সচিব পরিচয় দেয়া হাবিবুর রহমান জাহিদ এবং তার স্ত্রী ডা: আরিফা পারভীন রিপা। তিনি বর্তমানে নেত্রকোনা সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন।
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১নম্বর আমলি আদালতে (কোতোয়ালী সি আর মামলা নম্বর- ১০৫৫/২০২৪) মামলাটি দায়ের করেন ভুক্তভোগী মো: আনিসুর রহমান।
মামলার বিবরণে জানা যায়, মামলার বাদি আনিসুর রহমান ময়মনসিংহ নগরীর চরপাড়ায় অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ একজন ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। এখানে কর্মরত থাকা অবস্থায় আসামি ডা: আরিফা পারভিন রিপা তার স্বামী হাবিবুর রহমান জাহিদকে সাথে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা করতে আসেন। রিপা তখন ময়মনসিংহ সদরের উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা পদে কর্মরত ছিলেন। এই দম্পতি ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে এসে সক্ষতা গড়ে ওঠে আনিসুরের সাথে।
মামলায় আরো বলা হয়, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: আরিফা পারভিন রিপা ও তার স্বামী মামলার বাদি আনিসুর রহমানকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাকরি দেয়ার নাম করে ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নগদ ১০ লক্ষ টাকা নেয়। পরবর্তীতে হাসপাতালে চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি তারা। পরে তারা সুকৌশলে আনিসুর রহমান সহ তিনজনকে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব ও গণপূর্ত বিভাগের হিসাব সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সর্বমোট ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে ২০২৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আনিসুর রহমান ও তার আত্মীয়রা মিলে ময়মনসিংহ নগরের জিলা স্কুল রোডের ইউনিক টাওয়ারে গিয়ে ডা: আরিফা পারভীনের বাসায় গিয়ে আরও ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেন। বাকি টাকা চাকরি হলে দিবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়।
পরে, চাকুরি না হলে একই বছরের ২২ মার্চ আনিসুর রহমান প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার বাসায় গেলে তাদের মোট ২০ লাখ ৯০ হাজার টাকা ফেরত চান। পরে তারা টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় আনিসুর জানতে পারেন, হাবিবুর রহমান জাহিদ একজন প্রতারক।
তিনি নিজেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভুয়া সচিব হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার স্ত্রী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত থাকায় তারা সুকৌশলে বিভিন্ন প্রতারণা করে থাকেন।
আনিসুর রহমান জানান, এই দম্পতি দীর্ঘদিন ধরে একটি সুপরিকল্পিত প্রতারণা চক্র চালাচ্ছিলেন। তারা বিভিন্ন সরকারি দফতরে যেমন বাংলাদেশ রেলওয়ে, হাসপাতাল, ভূমি অফিস ইত্যাদিতে চাকরি দেয়ার জন্য যুবকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন।
স্বামীর ভুয়া সচিব পরিচয়ের সাথে স্ত্রীর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ব্যবহার করে প্রতারণামূলক লেনদেনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলতেন তারা।
জামিনে বেরিয়ে একই অপরাধে পুনরাবৃত্তি
মামলার নথিপত্র এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদের সূত্র অনুযায়ী, এই দম্পতির বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে চাকরি দেয়ার নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে এবং তারা গ্রেফতারও হয়েছিলেন।
জানা যায়, মো: হাবিবুর রহমান জাহিদ এবং তার সহযোগিরা ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ প্রতারণার অভিযোগে আটক হয়েছিলেন এবং পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু কিছুদিন জেল খেটে কারামুক্ত হওয়ার পরও তারা একই ধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রম শুরু করেন। তারা বারবার ভুয়া পরিচয়ে টাকা নিয়ে চাকরি না দিয়ে বা টাকা ফেরত না দিয়ে হয়রানি করছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন।
আনিসুর রহমান বলেন, ২১ লাখ টাকা দিয়ে এখন আমি নিঃস্ব। বারবার টাকা চেয়ে আমি এখন হুমকিতে আছি। টাকার চাপ সহ্য করতে না পেরে আমি বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি।
তিনি জানান, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: আরিফা পারভিন রিপার সাথে যোগাযোগ করা হলে তার স্বামীর সাথে বর্তমানে তার সম্পর্ক নেই বলে এড়িয়ে যান তিনি।
এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তার স্বামীর সাথে একটি ভুয়া তালাকনামা আমাকে পাঠিয়ে দেন। ২০২৪ সালের ৭ এপ্রিলের তালাকনামায় শুধুমাত্র ডা: আরিফা পারভীন রিপার স্বাক্ষর রয়েছে সেখানে।
এই দম্পতি দ্বারা প্রতারণার শিকার ময়মনসিংহ নগরীর আরেক ভুক্তভোগী যুবক ফয়জুর রহমান আব্দুল্লাহ।
হাবিবুর রহমান জাহিদ ও তার স্ত্রী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: আরিফা পারভীন রিপা তাকে বিমান বাহিনীতে চাকরি দেয়ার নাম করে আড়াই লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। পরে বাসা পরিবর্তন করে এখন থেকে চলে যান। পাওনা টাকা চাইতে গেলে নানান টালবাহানার পর ভুক্তভোগী যুবককে দেয়া হয় হত্যার হুমকি।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি মডেল থানায় তিনি একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে বারবার হাবিবুর রহমান জাহিদ ওরফে মিজানুর রহমানের একাধিক মোবাইল নম্বরে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অভিযুক্ত উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: আরিফা পারভীন রিপা বলেন, ‘যিনি টাকা নিয়েছেন তার সাথে এখন আমার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তিনি টাকা নিয়ে সে টাকা আমাকে দেন নাই। এখন মামলার ঘানি আমার টানতে হচ্ছে। আদালত থেকে আমাকে বলা হয়েছে টাকা পরিশোধ করার জন্য। কিন্তু আদালত এই রায় দিতে পারে না। আমি আইনজীবীর সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
নেত্রকোনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম জানান, সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: আরিফা পারভিন রিপার বিরুদ্ধে এর আগেও অনেক অভিযোগ শুনেছি। তারা স্বামী স্ত্রীর প্রভাব ও ভুয়া সচিব পরিচয় দিয়ে অনেকের কাছে টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
তবে সম্প্রতি শুনতে পেয়েছি তার স্বামীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। আগেও একাধিকবার তদন্ত হয়েছে কয়েকটি অভিযোগ নিয়ে। তার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আনিসুর রহমানের মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাবিবুল্লাহ বাহার জানান, মামলার ১ নম্বর ভুয়া সচিব পরিচয়দানকারী আসামি পলাতক আছেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ২ নম্বর আসামি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: আরিফা পারভীন রিপা মামলায় হাজিরা দিচ্ছেন। আদালত তাকে মোট টাকার ৩ ভাগের ১ ভাগ পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন।



