ছেলেকে ভালো পড়াশোনার জন্য শহরের নামি-দামি স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু এই স্কুলের শিক্ষকদের ‘রুঢ়’ আচরণই শেষ পর্যন্ত তার ছেলেকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেবে তা তিনি কখনো ভাবেননি। শহরের স্কলার্সহোম শাহি ঈদগাহ ক্যাম্পাসে এইচএসসি প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় স্কুলে ডেকে নিয়ে শ্রেণী শিক্ষক ও স্কুলের কর্তৃপক্ষ ছেলের সামনে মা-বাবাকেও অপমান করেন। বাবার অনুরোধ উপেক্ষা করে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিয়ে স্কুল থেকে বিদায় করে দেন।
এই অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় স্কলার্সহোম শিক্ষার্থী আজমান আহমদ দানিয়েল (২০)। তিনি নগরের সুবিদবাজার বনকলাপাড়া নুরানি আবাসিক এলাকার ৩৬/৯ নম্বর বাসার রাশেদ আহমদের ছেলে।
বুধবার বিকেল ৫টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। নিজ বাসার কক্ষে ভেন্টিলেটরের সাথে নাইলনের তার পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন আজমান। পরে পুলিশ এসে তার লাশ উদ্ধার করে। আজমান স্কলার্সহোম স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র এবং ২০২৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন।
বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্তের পর বিকেল ৩টার দিকে এ রিপোর্ট লেখার সময় গ্রামের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। সেখানেই তার লাশ দাফনের প্রস্তুতি চলছে। ছেলের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বুধবার থেকেই অজ্ঞান হয়ে আছেন বাবা রাশেদ আহমদ। মা বাবা বার বার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
আজমানের আত্মহত্যার ঘটনা এখন ‘টক অব দ্য সিলেট’। এই মর্মান্তিক ঘটনায় সমগ্র সিলেট জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজমানের মৃত্যু নিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তার মৃত্যুর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে দায়ি করে বিচারের দাবি উঠেছে।
স্কুলের কয়েকজন অভিভাবক ও মৃত আজমানের সহপাঠীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ স্কলার্সহোমর ২০২৬ সালের এইচএসসি প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ হয়। আজমান ২০২৬ সালের এইচএসসি’র প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় পাঁচ বিষয়ে ফেল করার কারণে শ্রেণী শিক্ষক তাকে ডেকে নিয়ে অনেক গালাগালি করেন। পরবর্তীতে স্কুলের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ তার মা-বাবাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে ছেলেকে এবং ছেলের সামনে মা বাবাকেও অপমান করেন এবং টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বিদায় করে দেন।
মৃত আজমানের পাড়া প্রতিবেশীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিনি নিয়মিত পাড়ার মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করতেন। খুবই নম্র, বিনয়ী ও ভদ্র প্রকৃতির ছিলেন।
এই আত্মহত্যার বিষয়ে এসএমপির মিডিয়া অফিসার এডিসি মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে জানান, ‘এয়ারপোর্ট থানার সুবিদবাজার বনকলাপাড়া নূরানী ৩৬/৯ বাসার বাসিন্দা আজমান আহমদ দানিয়েল (১৯) বাবা রাশেদ আহমেদ নিজ বাসার ভেন্টিলেটরের সাথে নাইলনের তার পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।
ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর এয়ারপোর্ট থানার এসআই (নি:) সেলিম মিয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ভিকটমকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। লাশ পোস্টমর্টেম এর জন্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়।
আজমান আহমেদ দানিয়েল স্কলার্সহোম শাহি ঈদগাহর ইন্টারমিডিয়েট বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ঘটনার সংবাদ পেয়ে উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) ও অফিসার ইনচার্জ এয়ারপোর্ট থানা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় ভিকটিমের বাবা, চাচা ও দাদাসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন এবং স্থানীয় ৭নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সাইয়েদ আব্দুল্লাহসহ এলাকার মানুষজন উপস্থিত ছিলেন।
ভিকটিমের পিতার সাথে কথা বলে জানা যায়, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় কলেজের প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের ডেকে নেন। ভিকটিমের পিতা মাতা দুই তিনদিন আগে কলেজে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করলে প্রাক নির্বাচনি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় তাকে তারা আগামী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেবেন না বলে জানান। রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে অমনোযোগিতা এবং নিয়মিত ক্লাসে অনুপস্থিতির বিষয়টি তারা জানান।
উক্ত ঘটনার বিষয়ে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।"
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজমানের মৃত্যু নিয়ে তার সহপাঠী ও বন্ধু বান্ধব এবং সিলেটের নেটিজেন স্কলার্সহোমের নানা অনিয়ম ও নেতিবাচক দিক তুলে ধরে আজমানের মৃত্যুর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে দায়ি করেছেন। ‘ট্রল কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি সিলেট’ পেইজে লিখা হয়েছে, ‘আজমান ভেঙ্গে পড়েছিল, আজমান একা হয়ে গিয়েছিল, আজমান শেষমেষ আত্মহত্যা করেছে।’ এই পেইজে আরো লিখা হয়, ‘আমরা বিচার চাই, আমরা দায় স্বীকার চাই, আমরা শিক্ষার্থীর জীবনের মর্যাদা চাই।’
এভাবে শতাধিক পোস্ট দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে।
আজমানের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে স্কলার্সহোমের প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপালের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।