কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদে ১০টি লোহার সিন্দুক ও তিনটি ট্রাঙ্কের দানবাক্স খোলা হয়েছে। গণনা শেষে ১২ কোটি নয় লাখ ৩৭ হাজার ২০৩ টাকা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সেইসাথে পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা, সোনা-রূপা ও হিরার অলঙ্কার।
শনিবার (৩০ আগস্ট) রাত ৮টায় গণনার কাজ শেষ হয়।
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দানবাক্স খোলা কমিটির আহ্বায়ক মো: এরশাদুল আহমেদের তত্ত্বাবধানে মসজিদের দানবাক্সগুলো খোলা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী ও অন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
সকাল ৭টায় দানবাক্সগুলো খোলার পর টাকাগুলো ৩২টি বস্তায় ভরা হয়। এরপর মসজিদের দোতলায় নিয়ে গণনা করা হয়।
দিনভর গণনা শেষে রাত ৮টায় মোট টাকার এ হিসাব পাওয়া যায়। মসজিদের দানবাক্স ভরে টাকা উপচে পড়ায় এবার অতিরিক্ত দু’টি দানবাক্স যুক্ত করা হয়েছিল।
টাকা গণনার কাজ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) জেসমিন আক্তার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দানবাক্স খোলা কমিটির আহ্বায়ক মো: এরশাদুল আহমেদ, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: কামরুল হাসান মারুফ, রূপালী ব্যাংকের এজিএম মোহাম্মদ আলী হারেছী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ মসজিদ কমিটির সদস্যরা তত্ত্বাবধান করেন।
প্রশাসন নিশ্চিত করে, এবার যে পরিমাণ টাকা পাওয়া গেছে এত টাকা এই মসজিদের ইতিহাসে আর কখনো পাওয়া যায়নি। সে হিসেবে এবারের দানের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করল।
নগদ টাকা ছাড়াও প্রতিবারের মতো এবারো দানবাক্সে মিলেছে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা, সোনা-রূপা ও হিরার অলঙ্কার।
অলঙ্কারের পরিমাণ তিন কেজি ছাড়িয়ে গেছে বলে মসজিদ সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
সাধারণত তিন মাস পর পর পাগলা মসজিদের দানবাক্সগুলো খোলা হয়। এবার চার মাস ১৮ দিন পর খোলা হয়েছে পাগলা মসজিদের দানবাক্স।
এর আগে, গত ১২ এপ্রিল মসজিদটির ১১টি দানবাক্স খুলে ২৮ বস্তা টাকা পাওয়া গিয়েছিল। সে সময় গণনা শেষে টাকার পরিমাণ ছিল নয় কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭। সেইসাথে মিলেছিল প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনা রুপার অলঙ্কার।
সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এই মসজিদে দান করলে মনের আশা পূরণ হয়। এই কারণে তারা টাকা পয়সা অলঙ্কারাদি নিয়ে ছুটে আসে এই মসজিদে। মুসলমান ছাড়াও অন্য ধর্মের লোকজনও এ মসজিদে দান করে থাকেন।
স্থানীয়রা জানান, এ মসজিদের দানবাক্স খুললেই পাওয়া যায় কোটি কোটি টাকা। দিন দিন এ মসজিদে দানের পরিমাণ বাড়ছেই। এ কারণে মসজিদের দানবাক্সে কি পরিমাণ টাকা পাওয়া গেল, তা নিয়ে লোকজনের থাকে অনেক কৌতুহল। তাই গণনা শেষে প্রতিবারই জানিয়ে দেয়া হয় টাকার অঙ্ক।
শনিবার (৩০ আগস্ট) রাত ৮টায় টাকা গণনা শেষে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান নয়া দিগন্তকে জানান, মসজিদের গচ্ছিত টাকা থেকে বিভিন্ন দান অনুদান দেয়ার পর পাগলা মসজিদের ব্যাংকের হিসাবে এ পর্যন্ত প্রায় ৯১ কোটি টাকা জমা ছিল। এবারের টাকা মিলে পাগলা মসজিদের জমাকৃত টাকা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেল।
টাকা ছাড়াও প্রতিদিন মসজিদটিতে কোরআন মজিদ, মোমবাতি, গবাদি পশু, ফলফলাদি ইত্যাদি মানত হিসেবে দান করা হয়।
সকালে দানবাক্সগুলো খোলার পর গণনা দেখতে মসজিদের আশেপাশে ভিড় করেন উৎসুক জনতা। পুলিশ র্যাব আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে টাকা গণনার কাজ শেষ হয়।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী নয়া দিগন্তকে জানান, সকাল ৭টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে খোলা হয় মসজিদের দানবাক্সগুলো। এরপর টাকাগুলো বস্তাবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় দোতলায়। টাকা গণনা শেষে ব্যাংকে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। পাশাপাশি ছিল র্যাব ও আনসার সদস্যরা।
টাকা গণনার কাজে জেলা প্রশাসনের কর্মী, মসজিদ সংযুক্ত মাদরাসার শিক্ষক শিক্ষার্থী, রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারী, মসজিদ কমিটির লোকজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ অন্তত পাঁচ শ’ মানুষ অংশ নেন।
স্থানীয়রা জানান, এ মসজিদের দানবাক্সে যে পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, তা দেশের আর কোনো মসজিদে মেলে না। টাকার সাথে সোনা-রূপার অলঙ্কারসহ থাকে বিদেশী মুদ্রাও। তাছাড়া প্রতিদিন বিপুল সংখ্যাক গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, ফলফলাদি, মোমবাতি ও ধর্মীয় বই দান করে থাকে লোকজন।
আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় দানবাক্সে পাওয়া চিঠিপত্র। এসব চিঠিতে লোকজন তাদের জীবনে পাওয়ার আনন্দ, না-পাওয়ার বেদনা, আয়-উন্নতির ফরিয়াদ, চাকরির প্রত্যাশা, পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের আশা ও রোগব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে আকুতি প্রকাশ করে। এবারো এমন কিছু চিঠি পাওয়া গেছে।
গত ১০ আগস্ট পাগলা মসজিদ পরিদর্শনে এসেছিলেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি তখন বলে যান, দানের টাকায় খুব শিগগিরই দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদের ১০ তলা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হবে। আধুনিক তুরস্কের বসফরাস প্রণালীর মসজিদগুলোর আদলে দৃষ্টিনন্দন, মাল্টিপারপাস ‘পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলা হবে। ১০ তলা বিশিষ্ট এই মসজিদে থাকবে অনাথ-এতিমদের জন্য লেখাপড়ার ব্যবস্থা, ধর্মীয় শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া ও আইটি সেকশন ইত্যাদি। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের মধ্যেই ১০ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার আশা প্রকাশ করেন তিনি।