কক্সবাজার মহেশখালী নৌপথে প্রথমবারের মতো সি-ট্রাক চলাচল শুরু হয়েছে। শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে পরীক্ষামূলকভাবে সি-ট্রাক চলাচল চালু করা হয়। কক্সবাজারের মহেশখালী নৌপথে সি-ট্রাক আসার খবরে মহেশখালী দ্বীপের অনেকের মাঝে আনন্দ ও খুশির আমেজ দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে যাতায়াতের অন্যতম রুটে ১৫ কিলোমিটার সমুদ্র পথে ফেরি চলাচলের মহেশখালী জনসাধারণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।
এদিন কক্সবাজার শহরের ৬ নম্বর ঘাট থেকে ছেড়ে আসা সি-ট্রাকটি নির্ধারিত সময়েই মহেশখালী জেটি ঘাটে পৌঁছায়। উপস্থিত যাত্রীরা উচ্ছ্বাস আর আশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে নতুন যাত্রা পথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মহেশখালীতে একটি নির্ভরযোগ্য ফেরি বা ট্রাক সার্ভিস চালুর দাবি জানিয়ে আসছিল দ্বীপবাসী। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে প্রতিদিন হাজারো মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা ও প্রশাসনিক প্রয়োজন মেটাতে যাতায়াত করেন। কিন্তু নৌপথে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবহনের অভাবে বরাবরই জনদুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। বিশেষ করে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ছোট ট্রলার ও কাঠের নৌকায় যাতায়াত ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও জীবননাশের আশঙ্কাজনক।
গত বছর ৫ আগস্ট মহেশখালীতে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের পর সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর নড়েচড়ে বসে। এরপরই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সি-ট্রাক চালুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়। পন্টুন স্থাপন, ঘাট উন্নয়ন এবং যাত্রার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পর অবশেষে পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু করা হয়।
সি-ট্রাক মূলত একটি মাঝারি আকারের, দ্রুতগামী ও সুরক্ষিত নৌযান, যা যাত্রী ও হালকা পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এতে আধুনিক আসন ব্যবস্থা, নিরাপত্তামূলক ফ্লোটেশন যন্ত্রপাতি এবং ভারী ঢেউ প্রতিরোধে সক্ষম প্রযুক্তি যুক্ত থাকে। সি-ট্রাক চালুর ফলে বিশেষ করে অসুস্থ, শিশু, নারীদের যাতায়াতে নতুন স্বস্তি আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
ঘাটে উপস্থিত যাত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, ‘আগে ট্রলার ধরে যেতে হত, কখনো ভয়ে উঠতে চাইতাম না। আজকে এই ট্রাকে আসতে পেরে মনে হলো এটাই চেয়েছিলাম।’
মহেশখালীর কলেজছাত্র মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সময় বাঁচবে। ঝুঁকিও কমবে। এটা এক বিশাল অগ্রগতি।’
জেলে পরিবার থেকে আসা সত্তরোর্ধ্ব মকবুল হোসেন বলছিলেন, ‘জীবনের এই বয়সে এসে শান্তিতে যাওয়ার ব্যবস্থা পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।’
বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (পরিচালনা) এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘সি-ট্রাকটি আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে। যাত্রীসেবা, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ শেষে দ্রুততম সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করা হবে।’
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: হেদায়েত উল্যাহ বলেন, ‘দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এটি। আমরা চাই সেবা যেন সঠিকভাবে অব্যাহত থাকে এবং দালালমুক্ত, সুশৃঙ্খল নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘এই রুটে সি-ট্রাক চলাচল চালু হলে শুধু যাত্রী নয়, পর্যটক এবং ব্যবসায়ীরাও আরো আগ্রহী হয়ে দ্বীপে আসবেন। পর্যটন সম্ভাবনাও বাড়বে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় গতি আসবে, পাশাপাশি দুর্যোগকালে দ্রুত সরিয়ে নেয়ার সুযোগ বাড়বে।’
সচেতন নাগরিকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ‘সঠিক তদারকি না থাকলে আবারো ঘাট ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি ভাড়া নির্ধারণ ও টিকিট ব্যবস্থা যেন জনবান্ধব হয়, সেই দিকেও নজর দিতে হবে। মহেশখালীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় দ্বীপে আধুনিক সি-ট্রাক চালু হওয়া নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে এই সম্ভাবনার পূর্ণ বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এর রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং জনগণের অংশগ্রহণের ওপর। সি-ট্রাক যেন কেবল পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আটকে না থাকে এ প্রত্যাশাই এখন দ্বীপবাসীর।