ডা: শফিকুর রহমান

আমরা মজলুম জনগণের বিজয় চাই

‘৮ দলীয় জোটকে ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে। যদি কেউ সেই ষড়যন্ত্রে পা দেয় সে হবে জাতীয় শত্রু।’

এরশাদ আলী, খুলনা ব্যুরো
এক মঞ্চে জামায়াত আমিরসহ ৮ দলীয় জোটের নেতারা
এক মঞ্চে জামায়াত আমিরসহ ৮ দলীয় জোটের নেতারা |ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা ৮ দলের বিজয় চাই না, আমরা ১৮ কোটি মানুষের বিজয় চাই, আমরা কোনো দল বিশেষের বিজয় চাই না, আমরা মজলুম জনগণের বিজয় চাই। আমরা আল্লাহর কোরআনের বিজয় চাই। আমরা যে ৫ দফার লড়াই করছি, সেই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে।

সোমবার (১ ডিসেম্বর) খুলনা নগরীর শিববাড়ী মোড়ে (বাবরী চত্বর) ৫ দফা দাবিতে আয়োজিত ৮ দলের খুলনা বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।

এ সময় জামায়াত আমির আরো বলেন, অনেকে ক্ষমতায় না গিয়েও ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন, কেউ কেউ বিভিন্ন জায়গায় বসে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন। জনগণ ভোট দিক বা না দিক তাদের ক্ষমতায় যেতেই হবে। কিন্তু বেলা শেষ, দিনও শেষ, ওই সূর্যও ডুবে গেছে। এদেশে এটা আর হবে না, আমরা হতে দেব না ইনশাল্লাহ।

তিনি বলেন, একটা দেশকে সভ্য দেশ হতে হলে সেই দেশটাকে দুর্নীতিমুক্ত হতে হয়। কিছু দল এবং ব্যক্তি বাংলাদেশকে দফায় দফায় দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করে বিশ্বের দরবারে অপমানিত করেছে। এদেশের সকলের অতীতের রেকর্ড জনগণের হাতে আছে।

তিনি বলেন, দুঃখের বিষয় যে ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি, বৈষম্য, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই বিপ্লবের পরের দিন থেকেই একটি গোষ্ঠী নিজেদের কপাল কিসমত গড়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চাঁদাবাজদের দৌরাত্মে সমাজজীবন অতিষ্ঠ, তটস্থ, ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বিনিয়োগকারী শিল্পপতি ব্যবসায়ী থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কেউ শান্তিতে নেই।

জামায়াত আমির বলেন, আগের চেয়ে চাঁদার রেট বেড়ে গেছে। তারা বলেন, আগেও ভালো ছিলাম না, এখন আরো খারাপ। কোনো দেশপ্রেমিক দল ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজ হয়ে আবির্ভূত হয়নি। যারা আবির্ভূত হয়েছিলেন দায় ও দরদ নিয়ে তাদের সাথে বসেছিলাম, তাদেরকে বলেছিলাম, এটি শহীদদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। এটা বন্ধ করতে হবে। যদি বন্ধ করা না হয়, বিপ্লবী জনগণ, তরুণ জনতা, ফুলের বাচ্চা নিয়ে যেসব মায়েরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তারা আমাদের ক্ষমা করবে না। বন্ধ করা হয়নি চাঁদাবাজি, চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা তরুণ যুবকদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই- যাদের বয়স ৩৫ বা তার নিচে- একটা ভোট দিতে পারো নাই। আগামীতে ভোট নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলুক, কেউ চুরি করুক, কেউ ভোট হাইজ্যাক করুক, তোমরা কি তা বরদাস্ত করবে? আমরা তোমাদেরকে কথা দিচ্ছি, তোমাদের ভোটের পাহারাদারি করার জন্য আমরা যুবক হয়ে সেদিন তোমাদের সাথে একইভাবে লড়ব ইনশাল্লাহ।

তিনি বলেন, এখন থেকে আমরা সারাদেশে জনগণের ব্যাপক ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি। এই ভালোবাসায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মনের জ্বালায় কেউ আমাদের ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, পোস্টারগুলো ছিড়ে খান খান করে ফেলছে। তারা টের পান নাই, জনগণ আজকাল পোস্টার, লাইট পোস্টার, রাস্তায় টানানো পোস্টার দেখে সিদ্ধান্ত নেয় না। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, যাদেরকে তারা ভালোবেসেছে তাদের বুকের ভেতরে তার পোস্টার স্থায়ীভাবে স্থাপন করেছে। রাস্তার পোস্টার ছিড়তে পারবা, বুকের পোস্টার ছিড়তে পারবা না। অতএব ওই পোস্টার ছেড়াছিড়ি করে কোনো লাভ নেই।

তিনি বলেন, দিশাহারা হয়ে, হতাশ হয়ে, ক্ষুব্ধ হয়ে চোরাগলিতে কেউ যদি হাঁটার চিন্তা করেন, তাহলে প্রয়োজনে আরেকটা ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে ইনশাল্লাহ। যেই ৫ আগস্ট সন্ত্রাসকে, ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়ে দিয়েছিল সেই ৫ আগস্ট প্রয়োজনে তাদেরও রুখে দেবে ইনশাল্লাহ।

তিনি আরো বলেন, এখন থেকে ছাত্র-জনতা, শ্রমিক জনতা, ব্যবসায়ী জনতা, আপামর জনতা, শিশু থেকে বৃদ্ধ সমস্ত মানবতার ঐক্য আমাদেরকে গড়ে তুলতে হবে। এই ঐক্যই আগামী দিনের জাতীয় সংসদে যাবে বিজয়ীর বেশে ইনশাল্লাহ। এই বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারণ, আমরা আছি মজলুমের পক্ষে, আমরা আছি অপশাসনের বিরুদ্ধে, আমরা আছি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আমরা আছি ন্যায়ের পক্ষে, আমরা আছি কোরআনের বিধানের পক্ষে। এ বিজয় আমাদের হবেই ইনশাল্লাহ।

জামায়াতের আমির বলেন, কেউ কেউ জাতির মধ্যে হিংসা সৃষ্টি করে জাতিকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করতে চায়, চিংড়ি মাছের মতো কেউ কেউ পেছনে দৌড়াতে চান। চিংড়ি যখন দৌড়ায় সামনের দিকে পথ খুঁজে পায় না। শুধু পেছন দিকে যায়। কেউ কেউ ৭২-র সংবিধান নিয়ে কামড় দিয়ে পড়ে থাকতে চান। আমাদের বন্ধুদের নিয়ে দীর্ঘদিন একসাথে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম লড়াই করেছি তাদের কাউকে কাউকে সে কথা বলতে শুনি। মনে রাখবেন, বাংলাদেশে প্রথম দুঃশাসনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ওই সংবিধানের আমূল পরিবর্তন করেছিলেন। এখন যদি কেউ ৭২-র সংবিধানের পক্ষে কথা বলেন, কার্যত তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। আজ যিনি সঙ্কটজনক অবস্থায় আছেন, জাতির এক শ্রদ্ধার কেন্দ্রবিন্দুতে যার অবস্থান সেই খালেদা জিয়াও ৭২-র সংবিধানের পক্ষে কথা বলেননি। আমরা আশা করব, যারা এই দুইজনকে ভালোবাসেন তারা ভুলেও আর ৭২-র ফ্যাসিবাদী সংবিধানের কথা বলবেন না।

সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মো: রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) বলেন, অনেকে বলেন- আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নই। কিন্ত আমরা নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তারাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে হিসাব নিকাশ করে দেখেছেন তাদের পায়ের তলে মাটি সরে গেছে। এবার নির্বাচন নিয়ে তারাই ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। গুন্ডামি করে, কেন্দ্র দখল করে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসবেন, সেদিন ভুলে যান। সে সুযোগ আর আপনারা পাবেন না।

খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে দেখতে পারছি- বাংলাদেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। ৭২ বাকশালপন্থী আর একভাগ ২৪’র বিপ্লবপন্থী শক্তি। রক্তের সাগর পেরিয়ে ২৪-এর জুলাই বিপ্লবের পর যেই ফ্যাসিবাদ বিতাড়িত করা হয়েছে, সেই ফ্যাসিবাদ বাংলার মাটিতে আসবে না। তিনি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করার দাবি জানান।

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সিনিয়র সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, এখনো সময় আছে, আপনারা জনগণের কাতারে আসুন। না হলে আওয়ামী লীগের মতো পালিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগ আমলে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে খুলনায়, গত এক বছরে তার চেয়ে দুই গুণ বেশি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই প্রশাসন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চাঁন বলেন, বাংলাদেশের মানুষ পরাধীনতা চায় না, তারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়।

বাংলাদেশ নেজামে ইসলামীর আমির অধ্যক্ষ মাওলানা সরওয়ার কামাল আজিজী বলেন, যারা শরিয়তি আইন মানে না আগামী নির্বাচনে জনগণ তাদেরকে লাল কার্ড দেখাবে।

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদেক হাক্কানি বলেন, ৮ দলীয় জোটকে ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র চলছে। যদি কেউ সেই ষড়যন্ত্রে পা দেয় সে হবে জাতীয় শত্রু।

দুপুর ১২টায় পবিত্র অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়। জামায়াতে ইসলামীর খুলনা মহানগর সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহানগরী সহ-সভাপতি শেখ মো: নাসির উদ্দিনের পরিচালনায় এতে আরো বক্তৃতা করেন খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতী সুলতান মহিউদ্দীন, মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও খুলনা অঞ্চল পরিচালক মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক, জামায়াতে ইসলামীর খুলনা অঞ্চল সহকারী পরিচালক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা শোয়াইব হোসেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি মোস্তফা কামাল, খুলনা মহানগরী আমির অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, খুলনা জেলা আমির মাওলানা মুহা: এমরান হুসাইন, সাতক্ষীরা জেলা আমির উপাধ্যক্ষ মো: শহীদুল ইসলাম মুকুল, বাগেরহাট জেলা আমির মাওলানা মো: রেজাউল করিম প্রমুখ।