মেয়েটার বয়স এখন ৬ মাস চলছে। জন্মের পর সে তার বাবার ছোয়াঁ পায়নি। জুলাই তো ঠিকই আসছে, কিন্তু আমার স্বামী তো এলো না। আমি না পেলাম স্বামীকে, না পেলাম স্বামীর হত্যার বিচার! আমার মেয়েটা জন্মের আগেই তার বাবাকে হারিয়ে এতিম হলো। আমার স্বামী দেশের বৈষম্য দূর করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। আমার সন্তান যেনো বৈষম্যের শিকার না হয়।
আজ শুক্রবার সকালে নিজ বাড়িতে কান্না জড়িত কণ্ঠে দৈনিক নয়া দিগন্তকে কথাগুলো বলছিলেন জুলাই যুদ্ধে শহীদ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিবের স্ত্রী সাদিয়া খাতুন।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী যখন ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যান তখন আমি তিন মাসের অন্তঃসত্তা। আমার স্বামী তার অনাগত সন্তানের মুখ দেখা যেতে পারেননি। বর্তমানে আমার ছয় মাসের কন্যা সন্তানই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বাবার নামের সাথে মিল রেখে সন্তানের নাম রাখা হয়েছে সাবরিনা বিনতে সিদ্দিক।’
গত ২০ জুলাই ময়মনসিংহের গৌরীপুরের কলতাপাড়া বাজারে তিনি ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন। শহীদ হওয়ার মাত্র ছয় মাস আগে ২০২৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাদের বিয়ে হয়।
নিজ বাড়ি গৌরীপুর উপজেলার দাওগাঁও হলেও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কোনাপাড়া মাদরাসায় চাকরি করতেন নূরে আলম। এই এলাকায় চাকরির সুবাদে তিনি বিয়ে করেন সাদিয়া খাতুনকে। মাত্র ছয় মাসের সংসারে স্বামীর স্মৃতিগুলোকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না তিনি।
এদিকে শহীদ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিবের বাবা দাওগাঁও তালিমুল কোরআন মহিলা মাদরাসার পরিচালক ও শিক্ষক আব্দুল হালিম জানান, চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে রাকিব ছিলেন তার একমাত্র ছেলে। তিন মেয়ের মধ্যে দু’জনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে মাদরাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ছে। গত বছর ১২ জানুয়ারি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের পলাশকান্দা গ্রামে ছেলেকে বিয়ে করান। বিয়ের সাত মাস পর বিধবা হন অন্তঃসত্ত্বা সাদিয়া। তখন পুত্রবধূ সাদিয়া আক্তার মাদরাসা শিক্ষার্থী, চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০ জুলাই সকালে স্ত্রীর জন্য ওষুধ আনতে গৌরীপুর উপজেলার কলতাপাড়ায় যান রাকিব।
তিনি বলেন, ‘শুনেছি কলতাপাড়ায় গোলোযোগ দেখে রাকিব নিজের মোবাইল দিয়ে ভিডিও করছিল। তখনই নাকি গুলিবিদ্ধ হয়। ওর তো কোনো দোষ ছিল না। ও তো রাজনীতিও করত না। তাহলে কেন গুলি করল তাকে।’
তিনি জানান, ‘রাকিবের কণ্ঠস্বর খুবই ভালো ছিল। ভিডিও করা তার শখ ছিল। তার ফেসবুক আইডি আছে, সেখানে গজল গেয়ে আপলোড করত। অনেক আশা ছিল, রাকিব সংসারের হাল ধরবে। বংশের বাতি হয়ে আলোকিত করবে। এখন তো সবই শেষ হয়ে গেল। বংশের বাতিটাই তো নিভে গেল।’
রাকিবের বাবা আক্ষেপ করে বলেন, ‘ছেলেকে হাফেজ বানিয়েছিলাম আমার মৃত্যুর পর জানাজা পড়াবে। ছেলের কাঁধে চড়ে কবরে যাব। কিন্তু বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত কষ্টের এটা আমার মতো হতভাগ্য ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না।
শহীদ রাকিবের স্ত্রী সাদিয়া আরো বলেন, ‘স্বামী শহীদ হওয়ার পরে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চলে আসি। আমার বাবা মায়ের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। বাবা এবং ভাই কোনো রকম ইনকাম করে আমাকে চালিয়ে নিচ্ছে। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে এবং আমার বাচ্চার খোঁজ খবর নেয় না। সরকারি যা সহযোগিতা করা হয়েছে তার বেশিভাগ টাকাই তারা নিয়ে গেছে।’
তিনি জানান, সন্তান জন্মদানের জন্য আমি যখন হাসপাতালে ভর্তি তখন সরকার থেকে জুলাই ফাউন্ডেশনের পাঁচ লাখ টাকা দেয়। আমি ভেবেছিলাম আমার শ্বশুরের কাছে সরকার সরাসরি টাকা দিলেও আমার সন্তানের জন্য কিছু টাকা দিবে। পরে তারা আমাকে কিছুই দেয়নি। এছাড়াও জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে থেকে শহীদের জন্য আরো অনেক আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাকে একটা টাকাও দেয়নি। আমি বর্তমানে আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আজ যদি আমার স্বামী থাকতো তাহলে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়তো না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এসব কথা শুনতে পেয়ে পাশে দাঁড়ায় সাদিয়া খাতুনের। সর্বশেষ জেলা পরিষদ থেকে অনুদানের এক লাখ ২৫ হাজার টাকার চেক তুলে দেয়া হয় তার হাতে।
সাদিয়ার দাবি, শহীদ পরিবারকে সঞ্চয় পত্রের ১০ লাখ টাকা যেন প্রকৃত ওয়ারিশ শনাক্ত করে বন্টন করে দেয়া হয়। এই টাকা যদি তার সন্তান না পায় তবে তাকে ভরণ পোষণ করাই কঠিন হয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গৌরীপুর উপজেলা আমির মাওলানা বদরুজ্জামান বলেন, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনে গৌরীপুরে তিন শহীদ হত্যার বিচার নিয়ে আমরা হতাশ। তাদের যারা প্রকাশ্যে হত্যা করল সে সকল সন্ত্রাসীরা আদালত থেকে জামিন পেয়ে যাচ্ছে, অনেকেই গ্রেফতার হয়নি। যারা নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেছে তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। জুলাই আন্দোলনের এক বছর চলছে কিন্তু দৃশ্যমান কোনো বিচার হয়নি। আমরা সরকারের কাছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের বিচার দাবি করছি।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন চলাকালে গত বছর ২০ জুলাই দুপুরে ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের কলতাপাড়ায় ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালায় পুলিশের সাথে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। ওই সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব, জুবায়ের হোসেন ও বিপ্লব।